শিং মাছের চাষ পদ্ধতি (আধুনিক কলাকৌশল)

শিং একক কিংবা রুইকাতলা জাতীয় মাছের সাথে চাষ করা যায়। পোনা পরিবহনে কোনো অসুবিধা হয় না এবং এর মৃত্যুর হার খুবই কম।

কম পানিতে বেশি সংখ্যক মাছ চাষ করা যায়। এসব মাছ বদ্ধ পানি বা পুকুরে বংশ বিস্তার করে। তাছাড়া, যেসব পুকুরেও চাষ করা যায়।

নিম্নে পুকুরে শিং মাছের চাষ পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো,

শিং মাছের চাষের সুবিধা

জিয়াল মাছ নামে পরিচিত আমাদের দেশে যে কম্বটি মাছ আছে তাদের মাঝে শিং মাছ অন্যতম। শিং মাছ খেতে সুস্বাদু এবং বেশ পুষ্টিকর।

শিং দেহে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ গ্রাম মাছে ২৩ গ্রাম প্রোটিন এবং মাত্র ০.৬ গ্রাম চর্বি সহ অন্যান্য হারে ক্যালসিয়াম, লোহা, ভিটামিন ইত্যাদি থাকে।

বেশি প্রোটিন এবং কম চর্বি থাকার কারণেই আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশে শিং মাছকে রোগীর পথ্য হিশেবে গণ্য করা হয়।

এসব নানাবিধ গুণাবলীর জন্য বাজারে শিং মাছের চাহিদা প্রচুর এবং চাহিদার তুলনায় যোগান কম বলে স¦াভাবিক ভাবেই দাম অপেক্ষাকৃত বেশি।

বাংলাদেশের মাটির বুনট, আবহাওয়া, তাপমাত্রা এবং জলবায়ু শিং মাছ চাষের জন্য উপযোগী। বদ্ধ জলাশয়ে এবং স্রোতের পানি এ দু’ধরনের পরিবেশে এ মাছ চাষ করা যায়।

তবে বদ্ধ জলাশয়েই শিং থাকতে বেশি পছন্দ করে এখানে দৈহিক বৃদ্ধিও বেশি হয়। পোনা উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম প্রজননের প্রয়োজন পড়ে না।

এ মাছ সহজে হাজা-মাজা পুকুরে চাষ করা যায় এবং এদের অতিরিক্ত শ্বাস যন্ত্র থাকায় অন্যান্য মাছের তুলনায় এদের জীবনশক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায়, প্রতিকূল পরিবেশে এরা সহজে বাঁচতে পারে।

শিং মাছের চাষ পদ্ধতি

আমাদেও দেশে ছোট বড় সব ধরনের পুকুওে শিং মাছ চাষ সম্ভব। তবে ১৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ আয়তনবিশিষ্ট ৩ থেকে ৪ ফুট গভীরতার পুকুরেই এ মাছ চাষ সুবিধা জনক।

পুকুর প্রস্তুতির সময় প্রতি শতাংশে আধা কেজি চুন পুকুরের তলায় ছিটিয়ে দিয়ে ৪/৫ দিন রোদে শুকানোন পর পানি ভর্তি করা উচিত। পুকুরের পানির গভীরতা ৩ থেকে ৫ ফুটের মধ্যে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

শিং মাছ যেহতু স্রোতের বিপরীতে চলতে বেশী পছন্দ করে তাই পুকুর প্রস্তুতির সময় পুকুরের পাড় ১ থেকে ২ ফুট উচু বাঁশের বানা কিংবা ছোট ফাঁস সমৃদ্ধ তারের জাল দিয়ে ঘেরাও করে দিতে হবে যাতে করে শিং পালিয়ে (বিশেষ করে পাড় দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার সময়) যেতে না পারে।

পুকুর প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্যায় শেষ হলে পোনা মজুদ করার আগে শতাংশ প্রতি ২০ থেকে ২৫ কেজি শুকানো গোবর পুকুরের পানিতে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

প্রয়োগকৃত গোবর একদিকে যেমন শিং সরাসরি খায়, অন্যদিকে ঐ জৈব সার জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যেরও সৃষ্টি করে।

পোনা সংগ্রহ

পুকুরে পোনা মজুদের জন্যে প্রাকৃতিক উৎস কিংবা হ্যাচারি থেকে পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক উৎস যেমন ধান ক্ষেত, বিল, ডোবা প্রভৃতি অগভীর স্থানে শিং ডিম পাড়ে।

শিং মাছ সারা বছরই প্রজনন করে। সাধারণত বর্ষাকালে শিং মাছের পোনার আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হলে শিং প্রজননকাল এবং পোনা সংগ্রহের সম্ভাব্য স্থান সম্পর্কে সম্যক ধারাণা থাকতে হবে।

শিং মাছের পোনা উৎপাদন এখনও আমাদেন দেশে আশানুরুপ পর্যায়ে পৌছায়নি। পুকুরে পোনা মজুদের লক্ষ্যে পরিবহন করার সময় শিং এর পোনা ক্ষত-বিক্ষত হয়।

তাই পুকুরে মজুদ করার পূর্বে শিং এর পোনাকে ফরমালিন এবং ম্যালাকাইট গ্রীন মিশ্রিত পানিতে (১০০ মি. লি. পানিতে ১ মিলিলিটার ফরমালিন এবং ০.১ মিলিগ্রাম ম্যালাকাইট গ্রীন) ধুয়ে নিলে শিং এর দ্রæত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে।

পোনা মজুদ

বিঘা প্রতি ১০০০০-২০০০০ পোনা ছাড়া যেতে পারে তবে তা নির্ভর করে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উপর। উন্নতমানের খাবার ও ব্যবস্থাপনা করা গেলে পোনা মজুদের পরিমান বাড়ানো যায়।

খাদ্য সরবরাহ

প্রতিদিন মোট খাবারের অর্ধেক সকালে এবং বাকি অর্ধেক বিকালে পুকুরের কিনাওে অল্প পানিতে ছিটিয়ে অথবা পানিরন ১ ফুট নিচে তালাতে দেয়া উচিত। এদের সঠিক বৃদ্ধির জন্যে শতকরা ৮০ ভাগ প্রাণীজ খাবার এবং ২০ ভাগ শুকনা জাতীয় খাদ্য প্রয়োজন।

মাছের ওজনের ৩-৪% হিসাবে এই সম্পূরক খাদ্য যোগান দেয়া যেতে পারে। পুকুর ছাড়াও ধানক্ষেত, ছোট ছোট চৌবাচ্চা, মিনি পুকুর,এ্যাকুরিয়াম এবং জলাশয়ে ভাসমান খাঁচায় শিং এর চাষ করা যেতে পারে।

যেসব ধান ক্ষেতে বছওে ৫/৬ মাস পানি থেকে সেসব ক্ষেতের আইল উঁচু করে বেঁধে শিং চাষ করা সম্ভব।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি কওে দিলে কৃত্রিম উপায়ে ধান ক্ষেতে শিং মাছের প্রজনন করানো যায়। ধান ক্ষেতের পানি রৌদ্র করোজ্জ্বল দিনে অত্যদিক গরম (৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে) হয়ে যেতে পারে।

ফলে শিং এর জীবনাঙ্কা দেখা দিতে পারে। তাই ধানক্ষেতে আইলের কাছে লম্বালম্বিভাবে ১ থেকে দেড় ফুট গভীর ‘রিফিউজ ক্যানেল’ তৈরি করা উচিত। এতে করে শিং এসব খালে আশ্রয় নিয়ে ক্ষেতের অত্যদিক গরম পানি থেকে নিজেদেরকে সহজেই রক্ষা করতে পারবে।

ধানক্ষেতে শিং এর জন্য কোন সম্পূরক খাদ্যেও প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষেতে নিয়মিতভাবে য়ে সার প্রয়োগ করা হয়, তাতে ধানক্ষেতের পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যেও সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সময়ে শিং এর খাদ্য হিশেবে ব্যবহৃত হয়।

মাছ ধরা

চাষের নির্দিষ্ট সময়ান্তে শিং মাছ ধরার জন্যে পুকুওে টানা জাল কিংবা খেপলা জাল ব্যবহার করা হয়। এভাবে পুকুর থেকে শতকরা ৬০ ভাগ মাছও ধরা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই শুকনো মৌসুমে পুকুর শুকিয়ে শিং মাছ ধরা উচিত।

অন্যদিকে ধান ক্ষেতেধান কাটা শেষ হলে সমস্ত মাছকে ‘রিফিউজ ক্যানেল’ নিয়ে সেখানে থেকে সহজেই ধরা সম্বব। শিং মাছ ধরার সময় এর কাঁটা সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকতে হবে।

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page