ভাঙ্গন মাছ (Bangana Fish) পরিচিতি: কৃত্রিম প্রজনন, চাষ ব্যবস্থাপনা ও পুষ্টিগুণ

বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে ভাঙ্গন মাছ (Bagna Fish, Labeo ariza) সুস্বাদু মাছ হিসেবে বিশেষ পরিচিত। এক সময় মাছটি খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড় এবং প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত।

কিন্তু দেশে প্রাকৃতিক জলাশয়ে পলিমাটি পড়ে ক্রমশঃ ভরাট হয়ে গভীরতা কমে যাওয়া, শিল্পকারখানার বর্জ্য, পৌর ও কৃষিজ আবর্জনার জন্য পানির দূষণ, নির্বিচারে মাছ আহরণের কারণে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে এ মাছটির প্রাচুর্যতা কমে যাচ্ছে।

ভাঙ্গন মাছের পরিচিতি

বৈজ্ঞানিক নাম: রেবা/ভাঙ্গন/ভাগনা মাছ/ভাঙ্গন বাটা (Bagna Fish, Labeo ariza)

-Bangana ariza (Hamilton, 1807)

শ্রেণীবিন্যাস

  • Kingdom : Animalia
  • Phylum : Chordata
  • Class : Teleostei
  • Order : Cypriniformes
  • Family : Cyprinidae
  • Genus : Bangana
  • Species : Bangana ariza

ভাঙ্গন মাছের আবাস্থল

এরা লাবিও আরিজা, সাধারণত আরিজা লাবিও নামে পরিচিত, মিঠা পানির মাছের একটি প্রজাতি যা সাইপ্রিনিডে পরিবারের অন্তর্গত। এটি দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিভিন্ন নদী ব্যবস্থায় পাওয়া যায়, বিশেষত ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে।

ভাঙ্গন মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য

ভাগনা মাছ একটি প্রসারিত এবং সুশৃঙ্খল শরীর রয়েছে। এটি প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) এর সর্বাধিক দৈর্ঘ্যে পৌঁছাতে পারে। মাছটি স্বতন্ত্র রঙ প্রদর্শন করে, একটি সোনালী-হলুদ দেহ এবং গাঢ় কালো উল্লম্ব স্ট্রাইপগুলি তার পাশ দিয়ে চলছে।

এর প্রাকৃতিক আবাসস্থলে বালুকাময় বা কাদা মাটির তলদেশসহ ধীর গতির নদী, স্রোত এবং পুকুরে বাস করে। এটি ঘন গাছপালা, ডুবে যাওয়া শিকড় এবং পতিত পাতাযুক্ত অঞ্চলগুলি পছন্দ করে, কারণ এগুলি লুকানোর জায়গা এবং প্রাকৃতিক খাদ্য উত্স সরবরাহ করে। প্রজাতিটি সর্বভোজী, শৈবাল, উদ্ভিদ পদার্থ, পোকামাকড়, ক্রাস্টেশিয়ান এবং ছোট জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী সহ বিভিন্ন ধরণের খাবার খাওয়ায়।

প্রজননের ক্ষেত্রে, বন্দী অবস্থায় লাবিও আরিজার নির্দিষ্ট প্রজনন অভ্যাস সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। বনাঞ্চলে, এগুলি সাধারণত বর্ষার মরসুমে প্রজনন করে যখন জলের স্তর বৃদ্ধি পায়। পুরুষ মাছগুলো প্রজনন মরসুমে তাদের স্নাউট এবং অপারেকুলায় টিউবারকল বিকাশের জন্য পরিচিত। এই টিউবারকলগুলি ছোট, সাদা এবং রুক্ষ প্রসারণ যা প্রেমের সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক আচরণে সহায়তা করে।

ভাঙ্গন মাছের প্রজনন কৌশল

পরিপক্বতা : ভাগনা মাছ জীবন চক্রের প্রথম বছরেই পরিপক্কতা লাভ করে ও বছরে একবার প্রজনন করে থাকে। এ মাছের প্রজননকাল মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে ।

ডিমের ধরণ : পরিপক্ক ডিম হালকা সবুজ থেকে তামাটে বর্ণের হয় । নিষিক্ত ডিম আঠালো হয় এবং নিমজ্জিত তৃণ ও আগাছা ইত্যাদিতে লেগে থাকে। এ মাছের লিঙ্গ অনুপাত ১:১ ধারনা করা হয় ।

ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও লালন

ভাগনা মাছের ব্রুড মাছ প্রতিপালনের জন্য পোনা উৎপাদনের জন্য ৩০-৫০ শতাংশ আয়তনের পুকুর নির্বাচন করা উত্তম। মাছ মজুদের পূর্বে অবশ্যই পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। উন্নত মানের পোনা উৎপাদনের জন্য প্রজনন ঋতুর ৩-৪ মাস আগ থেকেই প্রাকৃতিক উৎস হতে ব্রুড মাছ (প্রজননক্ষম মাছ) সংগ্রহ করে পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে।

মাছের খাদ্য হিসেবে চাউলের কুঁড়া, সরিষার খৈল, ফিশ মিল এবং ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ একত্রে মিশ্রিত করে অথবা বাজারে প্রাপ্ত ২৮-৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ পিলেট খাদ্য মাছের দেহ ওজনের ৩-৬% হারে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি সপ্তাহে ইউরিয়া ও টিএসপি সার (শতাংশে ১৫০ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে।

পুকুরে নিয়মিতভাবে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রজনন পুকুরে প্রয়োগ মোতাবেক বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।

কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন

পোনা উৎপাদনের জন্য ভাগনা মাছের স্ত্রী ও পুরুষ উভয়কে পিটুইটারি দ্রবণের (পিজি) ইনজেকশন দেয়া হয়। ভাগনা মাছের প্রজননের জন্য পিটুইটারি ইনজেকশন দেয়ার ৮-১০ ঘন্টা আগে ব্রুড মাছ ধরে হ্যাচারিতে সিমেন্ট সিস্টার্নে স্থানান্তর করতে হয়। এ সময় পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিশ্চিত করার জন্য সিস্টার্নে অনবরত পানির ফোয়ারা দিতে হবে।

নিচে হরমোন প্রয়োগমাত্রা দেয়া হলো :

মাছের লিঙ্গ১ম ডোজ(মি.গ্রাম/কেজি)২য় ডোজ(মি.গ্রাম/কেজি)মন্তব্য
স্ত্রী১.০৪.০-৫.০১ম ইনজেকশান দেয়ার ৬ ঘন্টা পর ২য় ইনজেকশান দিতে হয়
পুরুষ২.০

হরমোন প্রয়োগের পর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ১:১ অনুপাতে সিমেন্ট সিস্টার্নে স্থাপিত হাপায় রেখে পানির ঝর্ণা প্রবাহ দিতে হবে। সাধারণত ইনজেকশন প্রয়োগের ৬-৮ ঘন্টা পর মাছ ডিম দিয়ে থাকে। / ডিম ছাড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব ব্রুড মাছগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে সিস্টার্ন থেকে সরিয়ে ফেলতে হয় ।

নিষিক্ত ডিম হ্যাচারির সার্কুলার ট্যাংকে অথব ফানেল ইনকুবেটরে ২৪-২৬ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ফুটানো হয়। সাধারণত ১৬-১৮ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয়। ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার ২-৩ দিন পর রেণু পোনার ডিম্বথলি নিঃশেষিত হয়।

ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার কয়েক ঘন্টা পূর্ব থেকেই খাবার হিসেবে এদেরকে সিদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। সাধারণত ৫-৭ দিন বয়সেই ভাগনা রেণু পোনা নার্সারী পুকুরে ছাড়ার উপযোগী হয়। বর্তমানে পিজির পাশাপাশি বিভিন্ন সিনথেটিক হরমোন (ফ্লাশ, গোনাডিন, ওয়ানটাইম, ওভাপ্রিম ইত্যাদি) ভাগনা মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ।

ভাগনা মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা

ভাগনা মাছের পোনার নার্সারিতে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণে করা হয় :

সাধারণত ১০-৩০ শতাংশ এবং ৩-৪ ফুট গভীরতার পুকুর ভাগনা মাছের নার্সারির জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে। নার্সারি করার পূর্বে পুকুর শুকিয়ে তলদেশ মই দিয়ে সমতল করে প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।

হাঁস পোকা নিধনের জন্য প্রতি শতাংশে ১০ মিলি. সুমিথিয়ন রেণু ছাড়ার ২৪ ঘন্টা পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। রেণু ছাড়ার পূর্বে পুকুরের পানিতে বিষাক্ততা রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ গ্রাম রেণু পোনা ছাড়া যায়।

রেণু মজুদের পর নিম্নবর্ণিত সারণি অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করতে হবে :

নার্সারি পুকুরে খাদ্য সরবরাহের তালিকা সময় খাদ্য প্রয়োগের সময়

সময়খাদ্যপ্রয়োগ
১-৩ দিন১ কেজি ময়দা ও ৮-১০টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে০৩ বার
৪-৭ দিন১ কেজি রেণুর জন্য ১ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবন দিতে হবে দিন০২ বার
৮-১০ দিন১ কেজি রেণুর জন্য ১ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবন দিতে হবে দিন০২ বার
১১-১৫ দিন১ কেজি রেণুর জন্য ১.৫ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবন দিতে হবে দিন০২ বার
১৬-২০ দিন১ কেজি রেণুর জন্য ২.০ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবন দিতে হবে দিন০২ বার
এভাবে নার্সারি করলে প্রতি কেজি রেণু হতে ২.৫-৩.০ লক্ষ পোনা উৎপাদন করা সম্ভব।

ভাগনা মাছের মিশ্র চাষ

মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে ভাগনা মাছ রুইজাতীয় মাছের সাথে চাষ করা হয়ে থাকে ।

পুকুর প্রস্তুতি

ভাগনা মাছের মিশ্র চাষের জন্য ৫০-১০০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করাই উত্তম। পুকুরের গভীরতা ৫-৬ ফুট হতে হয়। এরপর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের পর শতাংশ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পরে পানির রং হালকা বাদামি হলে মাছ মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে

পোনা মজুদ ও ব্যবস্থাপনা

মিশ্র চাষের জন্য ৪-৫ সে.মি. আকারের ভাগনা মাছ, ৮-১০ সে.মি. আকারের রুইজাতীয় মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। ভাগনা মাছ অত্যন্ত নাজুক মাছ । তাই সকালে বা বিকেলে যখন সূর্যের তাপ কম থাকে তখন পুকুরে মাছের পোনা মজুদের কাজ করতে হবে।

ভাগনা মাছের মিশ্র চাষ মাছের প্রজাতি মজুদ ঘনত্ব

মাছের প্রজাতিমজুত ঘনত্ব
ভাগনা ৩০০
রুই ১২
কাতলা
সিলভার
মৃগেল
মোট ৩২৫

খাদ্য ব্যবস্থাপনা

পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে ২৫-২৮% প্রোটিন সমৃদ্ধ ডুবন্ত পিলেট খাদ্য ৩- ৮% দিনে ২ বার প্রয়োগ করতে হবে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত এক দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে

মাছ আহরণ ও উৎপাদন

পুকুরে ৬-৮ মাস লালনের পর মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রথমে পুকুরে ভালোভাবে জাল টেনে এবং পরবর্তিতে পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হয়। ভাগনা মাছের মিশ্র চাষ থেকে একর প্রতি সর্বমোট ২,৪০০-৩,২০০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব

পুষ্টিগুণ

এটি উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট রয়েছে।

তথ্যসূত্র

  • বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page