বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঋতুভেদে লবণাক্ততার পরিমাণ ওঠানামা করে। এতদঞ্চলে বিগত দুই দশক থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।
কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক পরিমাণ জলাশয় চিংড়ি চাষের উপযুক্ত নয়। এইসব জলাশয়ে ভেটকি ও তেলাপিয়ার মিশ্রচাষ খুবই সম্ভাবনাময়।
আমরা জানি তেলাপিয়া একটি মিঠা পানির মাছ, কিন্তু এর আদি উৎপত্তি লানো পানিতেই, তাই তেলাপিয়াকে লবণাক্ত পানিতে ভালভাবে বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
আবার ভেটকি যদিও একটি লবণাক্ত পানির মাছ, কিন্তু কিছুকাল আগেও উপকুলীয় অঞ্চলের স্বাদু পানিতে এই মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। তাই উপকূলীয় জলাশয়ে লবণাক্ততা সহ্যকারী এই দুইটি মাছের মিশ্রচাষ খুবই উপযুক্ত।
বাংলাদেশে ভেটকির বাজারদর উঁচু। অপরদিকে বড় সাইজের তেলাপিয়া যেমন সুস্বাদু তেমনি লানোপানির তেলাপিয়ার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর চাহিদা আছে। উপকূলীয় অঞ্চলের ম্যাগ্রোভ বনাঞ্চলের ক্ষতিসাধন না করেও মিশ্রচাষ করা যায়।
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চিংড়িচাষ প্রসারের ফলে ভেটকি আজ বিলুপ্ত প্রায়। তাই আর্থনীতিক গুরুত্বসম্পন্ন এই মাছটির বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভেটকি মাছ (Seabass, Bhetki, Lates calcarifer)
ভেটকি মাছ একটি জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু মাছ যা সাগরে পাওয়া যায়। বেটকি সেন্ট্রোলোপিনা পরিবারের একজন সদস্য যার মধ্যে গ্রুপার এবং স্ন্যাপারও রয়েছে।
এটির সারা শরীরে কালো দাগ সহ একটি আকর্ষণীয় রূপালী বা ধূসর রঙ রয়েছে, এটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় করে তোলে।
ভেটকি মাছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন A, D এবং B12 সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদার থাকে। যারা স্বাস্থ্যকর ডায়েটে আছেন এবং বিভিন্ন উপায়ে রান্না করা যায় তাদের জন্য এটি প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস।
তেলাপিয়া মাছ (Tilapia, Oreochromis niloticus)
তেলাপিয়া মাছ একটি অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় খাদ্য উৎস যা সারা বিশ্বের মানুষ উপভোগ করে। এই ধরনের মাছ হালকা-গন্ধযুক্ত এবং খুব বহুমুখী, এটি বিভিন্ন রেসিপিগুলির জন্য একটি দুর্দান্ত পছন্দ করে তোলে।
তেলাপিয়া অন্যান্য ধরণের মাছের তুলনায় খুব সাশ্রয়ী মূল্যের, যা বাজেট-মননশীল ভোক্তাদের জন্য তাদের একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হিসাবে তৈরি করে।
এই স্বাদুপানির মাছগুলি বহু শতাব্দী ধরে রয়েছে এবং প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের অনেক জায়গায় চাষ করা হয়েছে। এগুলি প্রাকৃতিক হ্রদ, নদী, স্রোত, পুকুরে পাওয়া যায়।
ভেটকি ও তেলাপিয়ার মিশ্রচাষের সুবিধা (Bhetki & Tilapia Integrated Culture)
এ মিশ্র চায়ে বেশ কয়েকটি সুবিধা আছে
-ভেটকি একটি দ্রুত বর্ধনশীল মাছ। এ মাছ খুবই সুস্বাদু এবং বাজারে প্রচুর চাহিদা আছে।
-মিশ্রচাষে এদের জন্য সম্পূরক খাদ্যের প্রয়াজেন হয় না, তেলাপিয়ার পোনা খেয়েই এরা বৃদ্ধি লাভ করে।
-তেলাপিয়ার একক চাষে মাঝে মাঝে ছাটে মাছ ধরে ফেলতে হয় যাতে খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য। প্রতিযািেগতা না হয়। কিন্তু ছাটে তেলাপিয়ার বাজারদর খুবই কম । মিশ্রচাযে ভেটকিই তেলাপিয়ার পোনা কমিয়ে ফেলার কাজটি করে।
-চিংড়ি অথবা রুই-কাতলা জাতীয় মাছ চাষ করা যায় না এমন জলাশয়েও মিশ্রচাষ সম্ভব।
-ভেটকি এবং তেলাপিয়া উভয়ই সহজে রাগোক্রান্ত হয় না।
-প্রতিকূল পরিবেশেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। ভেটকি এবং তেলাপিয়া উভয়ই স্বাদুপানি অথবা লানো পানিতে স্বাভাবিক বৃদ্ধি লাভ করে।
ভেটকি ও তেলাপিয়ার মিশ্রচাষ
পুকুর ব্যবস্থাপনা
মোটামুটি যে কোনাে আয়তনের পুকুরে মিশ্রচাষ করা সম্ভব হলেও এক একরের কাছাকাছি আয়তনের পুকুর ব্যবস্থাপনার জন্য সুবিধাজনক।
এ চাষের জন্য পুকুর থেকে অবাঞ্ছিত মাছ দূর না করলেও অসুবিধা হয় না, কারণ ভেটকি রাক্ষুসে মাছ।
তবে অপরাপর রাক্ষুসে মাছ না থাকাই ভাল। চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়াগে করতে হবে। চুন প্রয়ােেগর ৩-৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৩-৪ কেজি হারে পচা গাবের প্রয়াগে করতে হবে।
গোবর প্রয়ােগের ৬-৭ দিনের মধ্যে পুকুরের পানি সুবজাভ বর্ণ ধারণ করবে। যদি পানির রং সবুজাভ না হয় তবে রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া এবং টিএসপি প্রতি শতাংশে প্রয়াগে করলে পানি সবুজ রং ধারণ করবে।
এরপর প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ টি হারে প্রজননক্ষম তেলাপিয়া (২০-২৫ গ্রাম ওজনের) ছাড়তে হবে।
তেলাপিয়া ছাড়ার পরদিন থেকে পুকুরে মাটে যে পরিমাণ তেলাপিয়া আছে তার দৈহিক ওজনের শতকরা ৩-৪ ভাগ হারে চালের কুঁড়া দু’ভাগ করে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি পরীক্ষা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ১৫-২০ দিনের মাঝে এরা পুকুরে পানো ছাড়বে।
পুকুরে যখন পর্যাপ্ত তেলাপিয়ার পানো দেখা যাবে তখন প্রতি শতাংশে ৬-৮টি হারে ৫-১৫ গ্রাম ওজনের ভেটকির পানো ছাড়তে হবে।
তেলাপিয়া যাতে পর্যাপ্ত খাবার পায় সেজন্য ১৫ দিন পর পর প্রতি শতাংশে ২ কেজি হারে পচা গাবের কিংবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়াগে করা যেতে পারে।
ভেটকির জন্য কোনাে সম্পূরক খাবার প্রয়ােেগর প্রয়াজেন নেই, কারণ তেলাপিয়ার পানোই ভেটকির খাবার হিশেবে ব্যবহৃত হবে। তবে মাঝে মাঝে জাল টেনে দেখতে হবে পুকুরে ভেটকির জন্য পর্যাপ্ত তেলাপিয়ার পানো আছে কি না।
যদি তেলাপিয়ার পানোর সংখ্যা কম থাকে তবে বড় সাইজের কিছু ভেটকি ধরে বাজারজাত করতে হবে। আবার যদি তেলাপিয়ার পানোর সংখ্যা খুব বেড়ে যায় তবে জাল টেনে তেলাপিয়া কমিয়ে ফেলতে হবে অথবা কিছু নতুন ভেটকি পুকুরে ছাড়তে হবে।
৬ মাস থেকে ১ বছরের মাঝে পুকুরের সমস্ত মাছ ধরে ফেলা যেতে পারে তবে পুকুরে তেলাপিয়ার সংখ্যা এবং ভেটকির সাইজের উপর নির্ভর করে বছরের যে কোনো সময়ই মাছ বাজারজাত করা যেতে পারে।