মহাশোল মাছ (Mohashol fish, Tor tor) বাংলাদেশে বিদ্যমান বিপন্ন প্রজাতির কার্প জাতীয় মাছের মধ্যে অন্যতম। একসময় বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের (যেমনঃ ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম) খরস্রোতা নদী, ঝর্ণা, লেক এবং পার্শবর্তী খালে-বিলে ২ টি প্রজাতি মহাশোলের (Tor tor Ges এবং Tor putitora) প্রাচুর্যতা ছিল।
বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারণে এদেশে মহাশোলসহ বহু মূল্যবান মৎস্য প্রজাতির বিচরন এবং প্রজননক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক জরাশয়ে মহাশোলের প্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়ে মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মহাশোল মাছের বৈশিষ্ট্য
পাহাড়ি খরস্রেোতা নদী, ঝর্ণা এবং লেক এদের মূল আবাস্থল। শীতকালে অপেক্ষাকৃত নিম্ন তাপমাত্রায় এ মাছটি প্রজনন করে থাকে। কার্প প্রজাতির অন্যান্য মাছের সাথে এর মিশ্রচাষ করা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যান্ত বেশি বলে এ মাছটি সাধারণত রোগাক্রান্ত হয় না।
নিয়ন্ত্রিত প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল
ব্রুড মাছ ব্যবস্থাপনা কৌশল
সাধারণত নভেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত মহাশোল মাছের সর্বানুক’ল প্রজননকাল, যখন পুকুরের পানির তাপমাত্রা ১৭-২২* সে. বজায় থাকে। সাারাবছর পানি থাকে এমন ৪-৫ ফুট গভীর পুকুর প্রজননক্ষম মাছের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্রজনন মৌসুমের ১-২ মাসের পূর্বে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা পুকুরে মজুদ করলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
মাছের পরিপক্বতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিদিন পুকুরে ২-৩ ঘন্টা পরিষ্কার পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। মজুদকৃত ব্রুড মাছকে ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য দেহ ওজনের ৪-৫% হারে প্রতিদিন সরবরাাহ করতে হবে পুকুরে উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য হেক্টর প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া ও ৪০ কেজি টি এস পি ১৫ দিন পরপর পর্যাক্রমে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রজননক্ষম মাছ নির্বাচন, নিয়ন্ত্রিত প্রজনন ও পোনা প্রতিপালন
প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ক স্ত্রী মাছের ডিম্বাসয় ডিমে ভর্তি থাকে বলে পেট ফোলা ও স্ফীত হয় এবং বক্ষ পাখনা মসৃন থাকে। পুরুষ মাছের বক্ষ পাখনা খসখসে এবং জননাঙ্গের সামান্য উপরে চাপ দিলে সাদা মিল্ট বের হয়ে আসে। নিষিক্ত ডিমগুলোকে কয়েকবার ডিপটিউবওয়েলের পানি দিয়ে ধুয়ে ডিমের আঠালুভাব দুর করে হ্যাচিং জারে স্থাপন করা হয়।
সাধারণত ২১-৩০* সে. পানির তাপমাত্রায় ৭২-৮০ ঘন্টা পর ডিম ফুটে লার্ভি বের হয়ে আসে। মহাশোল মাছের ডিমের পরিস্ফুটনের হার ৭০-৭৫% হয়ে থাকে। লার্ভির বয়স পাঁচ দিন হলে এদের খাবার হিসেবে হাঁস মুরগির ডিমের সিদ্ধ কুসুম সরবরাহ করা হয় এবং এ সময়ই রেণুপোনা আঁতুড় পুকুরে ছাড়ার উপযোগি হয়। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত রেণুপোনার বাঁচার হার ৮০-৯০% হয়ে থাকে।
নার্সারি পুকুরে পোনা লালন কৌশল
মহাশোলের নার্সারি ব্যবস্থাপনার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবেঃ
নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ০.৮০-১.০ মিটার হতেহবে। পুকুরে পানির ইনলেট ও আউটলেট থাকা নার্সারি পুকুরের পানির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সাধারণ কার্প জাতীয় মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনার মত মহাশোলের নার্সারি পুকুর থেকে বিভিন্ন ধরণের জলজ আগাছা যেমন- কচুরিপানা, টোপাপানা, ক্ষুদি পোনা এবং তন্তু জাতীয় বিভিন্ন শেওলা দমন করতে হবে।
শুষ্ক পুকুরের তলদেশে বা নির্ধারিত গভরিতায় পানিতে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্র চুন প্রয়োগের ১-২দিন পর প্রতি শতাংশে ১০ কেজি হারে গোবর প্রয়োগ করতে হবে। গোবর প্রয়োগের ৫-৬ দিন পর পুকুরের পানি হাালকা বাদামী রং ধারন করলে পুকুর পোনা মজুদের উপযোগি হয়।
পোনা মজুদের ২৪ ঘন্টা পূর্বে পতি শতাংশে ১০ মিলি. হারে প্রয়োগ করে হাঁস পোকাসহ অন্যান্য অনিষ্টকারি পোকা বা বড় আকারের জ্যুাপ্লাংক্টন দমন করা যায়। নার্সারি পুকুরে পোনা মজুদের পর সম্পূরক খাবার হিসেবে ১ম সপ্তাহে নার্সারি ফিড এবং পরবর্তী ৬ সপ্তাহে একবার নমুনায়ন করে পোনার স্বাস্থ পরক্ষিার মাধ্যমে খাবারের পরিমাণ সমন্বয় করা আবশ্যক। এভাবে ২ মাস পোনা লালন পালনের পর পোনার আকার যখন ৬.০-৭.০সেমি. হলে চাষের পুকুরে ছাড়ার উপযোগী হয়।
আহরণ ও উৎপান
নার্সারি পুকুরে ২ মাস লালনের পর পর্যাক্রমে জাল টেনে এবং পুকুর শুকিয়ে চারা পোনা আহরণ করা হয়। এ ধরণের নার্সারি ব্যবস্তাপনায় হেক্টর প্রতি গেেড় ৫.০-৫.৫ লক্স আঙ্গুলি পোনা উৎপাদন করা যায়।
মহাশোল মাছের মিশ্রচাষ ব্যবস্থাপনা
আধুনিক মৎস চাষে রুইজাতীয় মাছের সাথে মহাশোল মাছের মিশ্রচাস করা যায়। ফলে পুকুরের সকর স্তরের পানির উৎপাদনশীলতাকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে কাঙ্খিত পরিমাণে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান সব ধরণের প্রাকৃতিক খাদ্যের পুরোপুরি ব্যবহার নিশ্চিত করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হলো মিশ্রচাষের প্রধান উদ্দেশ।
মিশ্রচাষের ধাপসমূহ সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণনা করা হলোঃ
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
মহাশোল মাচের চাষ পদ্ধতি অনেকটা অন্যান্র কার্প জাতীয় মাচের চাষ পদ্ধতির মতই। নিম্নে সংক্ষেপে পুকুর নির্বাচন ও চাষ পদ্ধতির ধাপগুলো বর্ণনা করা হলোঃ
মিশ্রচাষের জন্য পুকুরের আয়তন ৪০-১০০ শতাংশ এবং বছওে ৮-১২ মাস ১.০-১.৫ মিটার পানি থাকে এরকম পুকুর নির্বাচন করা যেতে পারে। জলজ আগাছা যেমন- কচুরিপানা, কলমীলতা, হেলেঞ্চা ইত্যাদি শেকড়সহ দমন করা প্রয়োজন। পুকুর শুকিয়ে অথবা রোটেনন পাউডার প্রয়োগ কওে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দমন করতে হবে।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিধর জন প্রতি হেক্টরে ২৫০ কেজি হারে চুন ছিটিয়ে দিয়ে দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর প্রতি হেক্টরে ১২.৫ কেজি ইউরিয়া এবং ২৫ কেজি টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ৬-৭ দিনের পর পুকুরের পানি সবুজাভ হলে মাছের পোনা মজুদের উপযোগী হয়।
পোনা মজুদ
কাঙ্খিত উৎপাদন পেতে হলে ৫-৬ ইঞ্চি আকারের সুস্থ ও সবল পোনা প্রতি হেক্টরে ৭৫০০ টি মজুদ করতে হবে
বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা মজুদেও জন্য নিম্নের সারণি অনুসরণ করা যেতে পারেঃ
মাছের প্রজাতি | মজুদ হার (%) | মজুদ ঘনত্ব(সংখ্যা/হেক্টর) |
কাতলা | ৪০ | ৩,০০০ |
রুই | ৩০ | ২,২৫০ |
মৃগেল | ১৫ | ১,১২৫ |
মহাশোল | ১৫ | ১,১২৫ |
সম্পূরক খাদ্য ও সার প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা কৌশল
মাছের দ্রুত বৃদ্ধিধর জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি পুকুরে সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। মাছ ছাড়ার পরের দিন থেকে মজুদকৃত পোনার দৈহিক ওজনের শতকরা ২-৪ ভাগ হারে চালের কুরা (৪০%), গমের ভূসি (২০%), সরিষার খৈল (২০%), এবং ফিসমিল (২০%) একত্রে মিশিয়ে বল আকাওে পুকুওে কতিপয় নির্দিষ্ট জায়গায় সরবরাহ করতে হবে।
প্রতিমাসে নমুনায়ন করে মাছের স্বাস্থ্য পরিক্ষাসহ মাছের দৈহিক ওজনের সহিত সঙ্গতি রেখে সম্পূরক খাদ্যের সমন্বয় করতে হবে। পোনা ছাড়ার পর ২০ দিন অন্তর প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাপ্যতা সাপেক্ষে প্রতি হেক্টরে ১২.৫ কেজি ইউরিয়া ও ২৫ কেজি টিএসপি পর্যাক্রমে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে পানির গুনাগুন যেমন- তাপমাত্রা, অক্সিজেন, পিএইচ, মোট ক্ষারত্ব ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতে হবে
আহরণ ও উৎপান
পোনা মজুদেও ৮-১০ মাস পর জাল টেনে বা পুকুর শুকিয়ে মাছ আহরণ করতে হবে। জীবিত বা তাজা মাছ বাজাওে বিক্রি করে অধিক মুনাফা পাওয়ার লক্ষে সময়মত মাছ আহরণ নিশ্চিত করতে হবে।
বাৎসরিক পুকুরে ৮-১০ মাস মিশ্র চাষে মহাশোল মাছ ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি কাতলা ২,২০০-২,৪০০ কেজি, রুই ১,৫০০-১,৭০০ কেজি, মৃগেল ৭০০-৭৫০ কেজি এবং মহাশোল ৬৫০-৭০০ কেজি উৎপাদন পাওয়া যায়।
References
- বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট