কই মাছ (Koi Fish): পরিচিতি, চাষ পদ্ধতি ও রোগ ব্যবস্থাপনা

কই মাছ (Koi Fish, Anabus testudineus) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক খাদ্য মাছ, একটি সুস্বাদু মাছ হিসাবে বিবেচিত। এই মাছ হাঁটার ক্ষমতা জন্য বেশ বিখ্যাত।

এটি দীর্ঘ সময় ধরে পানির বাইরে থাকতে পারে। সাধারণত এমন বাজারগুলিতে সরাসরি বিক্রি করা হয় যেখানে এটি আর্দ্র রেখে বেশ কয়েক দিন ধরে এটি জীবিত রাখা হয়।

এই নিবন্ধে, আমরা কই মাছ পরিচিতি, চাষ পদ্ধতি ও রোগবালাই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কই মাছ পরিচিতি (What is Koi Fish)

সাধারণ নাম (Local Name): কই (Koi)

বৈজ্ঞানিক নাম (Scientific Name of Koi Fish): এনাবাস টেস্টুডিনিয়াস (Anabas testudineus)

কই মাছের ইংরেজি নাম (English Name of Koi Fish): এটি সাধারণত Climbing Perch (ক্লাইম্বিং পার্চ )নামে পরিচিত।

খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরণের মাছ চাষ করা যেতে পারে। মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং যে রোগগুলি তাদের প্রভাবিত করতে পারে তা মাছের ধরণের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।

কই মাছের চাষের সুবিধা। কই মাছের উপকারিতা (Importance of Koi Fish)

-কই মাছ বিশেষত বড় কই মাছের চাহিদা বিত্তবান শ্রেণীর কাছে অত্যন্ত বেশি। রোগীর পথ্য হিসেবেও এ মাছের চাহিদা রয়েছে এবং বেশ চড়া দামে এ মাছ বিক্রি করা যায়।

-অন্যান্য জিওল মাছ চাষে যে সুবিধা রয়েছে, কই মাছ চাষেও তেমন সুবিধা রয়েছে। বিশেষ করে পুকুরে মাছের মৃত্যু হার খুবই কম।

অতিরিক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গ থাকায় এরা অপেক্ষাকৃত প্রতিকূল অবস্থায়ও জীবন ধারণ করতে পারে এমনকি শুকনো মৌসুমে জলাশয়ে পানি শুকিয়ে গেলে কাদার নিচে আত্মগোপন করে বেঁচে থাকে।

-কই, মাগুর ও শিং মাছ একই পুকুরে এবং একসঙ্গে চাষ করা ভাল। কারণ ওরা সবাই বদ্ধ জলাশয়ে ডিম ছাড়ে এবং তা থেকে বাচ্চা হয়। কই চৌবাচ্চায় এবং খাঁচাতেও চাষ করা যায়।

-কই মাছ চাষে লাভ শিং মাছ থেকে বেশি এবং মাগুরের সমান। কই মাছ পানির সর্বস্তরের খাদ্য খায়।

কই মাছের বৈশিষ্ট্য ও দেহের বিবরণ (Koi Fish Characteristics)

এ মাছের মাথা বড় ও প্রায় ত্রিকোণাকৃতি। বর্ণ কালচে সবুজ বা বাদামি সবুজ। দেহ আঁশ দিয়ে ঢাকা, দু’ টো চোয়ালেই দাঁত আছে, পিঠের পাখনাযুক্ত কাঁটাগুুলো ধারালো।

-প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার পরিমাপের মাছ জলপাই সবুজ রঙের।

-সাইক্লোইড স্কেল দ্বারা আচ্ছাদিত মাছের দেহ এবং মাথা, ট্রাঙ্ক এবং লেজে বিভক্ত।

-ডরসাল ফিন পূর্ববর্তী ডরসাল ফিন এবং পশ্চাদমুখী ডরসাল ফিন নিয়ে গঠিত। অনুরূপ পায়ুসংক্রান্ত ফিন পূর্ববর্তী পায়ুসংক্রান্ত ফিন এবং পশ্চাদপদ পায়ুসংক্রান্ত ফিন মধ্যে বিভক্ত। কডাল ফিন ফ্যান আকৃতির।

-স্কেলগুলি বড় এবং নিয়মিতভাবে সাজানো, সিলিয়েট।

-একটি আনুষাঙ্গিক বায়ু-শ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গ (Air breathing organ) রয়েছে। যদি বাতাসের শ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গগুলি আর্দ্র রাখা যায় তবে জলের বাইরে বেশ কয়েক দিন বা সপ্তাহ বেঁচে থাকতে সক্ষম।

তার অত্যন্ত মোবাইল suboperculum এবং শক্তিশালী পাখনা মেরুদন্ড ব্যবহার করে জলের শরীরের মধ্যে সরানোর জন্য জমির উপর নিজেকে টানা।

প্রাপ্তিস্থান (Geographical Distribution of Koi Fish)

তবে এটি পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই দারুসসালাম এবং সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়।

পানির অবস্থা (Optimum Water Parament)

  • তাপমাত্রা: 15 – 30 °C
  • পিএইচ: 5.5 – 8.0
  • কঠোরতা: 36 – 447 পিপিএম

বাসস্থান (Habitat of Koi Fish)

যদিও প্রাথমিকভাবে একটি নিম্নভূমি, মিঠা পানির প্রজাতি এটি কিছু অঞ্চলে উপকূলীয় পরিবেশেও দেখা যায়।

পুকুর, ডোবা-নালা, নর্দমা, হাওড়বাওড় ইত্যাদি জলাশয়ে পানির মধ্যে ও নিচের স্তরে বাস করে।

জলাভূমি, জলাভূমি, হ্রদ, খাল, পুল, ছোট গর্ত, চালের ধান, পুডল, অক্সবোস, উপনদী এবং প্রধান নদী চ্যানেলসহ বিভিন্ন ধরণের আবাসস্থলে রেকর্ড করা হয়েছে।

প্রাপ্তবয়স্করা মাঝারি থেকে বড় নদী, ব্রুক, প্লাবিত ক্ষেত্র এবং মন্থর প্রবাহিত খাল সহ স্থির জলাশয়গুলিতে দেখা যায়। প্রায়শই ঘন গাছপালাযুক্ত অঞ্চলে পাওয়া যায়।

অত্যন্ত প্রতিকূল জলের অবস্থা সহ্য করতে পারে এবং প্রধানত ঘোলা, স্থির জলের সাথে থাকে। শুকনো মৌসুমে কাদার নিচে চাপা পড়ে থাকে।

শুষ্ক মৌসুমে, তারা নিমজ্জিত বন এবং গুল্মের সাথে যুক্ত পুলগুলিতে থাকে।

পুষ্টিমান (Koi Fish Nutrition Value)

প্রতি ১০০ গ্রাম কই মাছে প্রোটিন ১৪.৮ গ্রাম, ফ্যাট ৯.৬ গ্রাম ও লোহা ১.৪ গ্রাম এবং ক্যালসিয়াম ৮২২ মি.গ্রা., ফসফরাস ৪০০ মি.গ্রা. এবং পানির রিমাণ ৭২ ভাগ।

খাদ্য (Koi Fish Feed)

ছোট অবস্থায় অতি ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ও কীটপতঙ্গ খায় এবং বড় হলে পতঙ্গঁ ও তাদের শুককীট, শৈবাল এবং পুকুরের তলার সঞ্চিত জৈবপদার্থ খায়।

প্রধানত শিকারী যদিও তবে শৈবাল এবং চালের শস্যের পাশাপাশি ছোট মাছ, অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং মলাস্ক সহ কিছু উদ্ভিজ্জ পদার্থকে খায়।

অ্যাকোয়ারিয়ামে হিমায়িত খাবার যেমন কেঁচো বা শেলফিশ গ্রহণ করে।

মাছ ধরা ও বাজারজাতকরণ (Harvesting & Marketing)

৩/৪ ইঞ্চি বড় হলেই কই মাছ জালের সাহায্যে অথবা সেচের মাধ্যমে ধরা যায়। এ মাছ দেশের অভ্যন্তরীন বাজারে এবং বিদেশে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। বর্তমানে প্রতি কেজি বড় কই মাচের দাম প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

প্রজনন (Koi Fish Breeding)

কই মাছ ৪ সে.মি এর মত বড় হলেই প্রজননক্ষম হয়। বর্ষাকাল এ মাছের প্রজনন সময়। এ মাছ ধানক্ষেত, পুকুর, ডোবা, নালা, খাল, বিলে প্রজনন করে।

যে জায়গায় এ মাছ বাস করে সেখানে প্রজনন করে না। ইনজেকশনের সাহায্যেও কৃত্রিম উপায়ে এ মাছের প্রজনন করানো যায়।

যৌন সক্রিয় মহিলারা পুরুষদের তুলনায় সামান্য বড় এবং লক্ষণীয়ভাবে ঘন দেহের হয়, যখন পুরুষরা রঙে গাঢ় হয় এবং প্রজননের সময় পেকটোরাল পাখনাগুলিতে আপাতদৃষ্টিতে টিউবারকুলগুলি বিকাশ করে।

হরমোনের সহায়তা ছাড়া এটি খুব কমই অ্যাকোয়ারিয়াতে প্রজনন করা হয় তবে এটি আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব যে মাছটি এক বছরেরও কম বয়সে যৌন পরিপক্ক হয়ে উঠছে এবং দৈর্ঘ্যে ১০০ – ১২০ মিমি পরিমাপ করে।

যখন স্প্যানিং অবস্থায় পুরুষরা শরীরের একটি লালচে রঙ বিকাশ করে, বিশেষ করে পেকটোরাল এবং ভেন্ট্রাল পাখনাগুলিতে এবং একটি কালো, হীরা-আকৃতির চিহ্নটি কডাল পেডাঙ্কেলের উপর উপস্থিত হয়।

তখন মহিলারা কেবল একটি অস্পষ্ট লালচে রঙ প্রদর্শন করে যখন কডাল পেডাঙ্কল স্পটটি আকারে আয়তাকার এবং কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে।

মহিলারাও ডিম দিয়ে পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে গোলাকার হয়ে যায় এবং পুরুষদের মধ্যে অনুপস্থিত ভেন্টে একটি বিশিষ্ট বাল্জ প্রদর্শন করে।

প্রকৃতির মধ্যে ডিমগুলি বর্ষার শুরুতে খোলা জলে জমা হয় এবং পুরুষটি নিজেকে মহিলার চারপাশে মোড়ানো হয় এবং ডিমগুলি রাখার সাথে সাথে নিষিক্ত করে।

ডিমগুলি আঠালো হয় না এবং পৃষ্ঠের উপরে উঠে যায় যেখানে তারা হ্যাচিংয়ের আগে প্রায় ২৪ ঘন্টা ধরে ভাসতে থাকে। ফ্রাই হ্যাচিংয়ের দুই দিনের মধ্যে প্রায় ২-৩ মিমি লম্বা এবং সাঁতার কাটতে শুুরু করে।

এই প্রজাতিটি অ্যাকোয়ারিয়াম বাণিজ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় নয় তবে এর রঙের অভাব সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। জলের অনুপস্থিতিতে তার বেঁচে থাকার ক্ষমতা ছাড়াও এটি শ্রবণযোগ্য শব্দ তৈরি করতে সক্ষম।

কৈ মাছের প্রজনন কাল শুরু হয় এপ্রিল মাস হতে এবং অব্যহত থাকে জুন মাস পযর্ন্ত। এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের ধাপসমূহ নিম্নরূপ :

১. প্রচননের জন্য হরমোন ইনজেকশন দেয়ার ৮-১০ ঘন্টা আগে ব্রুড কৈ মাছ হ্যাচারিতে সিমেন্ট সিষ্টার্ণে স্থাপিত গ্যাস নাইলনের স্থানান্তর করা হয়।

২. এ সময় পানিতে অক্সিজেন নিশ্চিত করার জন্য হাপায় কৃত্রিম প্রবাহ দিতে হবে।

৩. স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে ১টি করে পিটুইটারী দ্রবণের ইনজেকশন দিতে হয়।

৪. প্রতি কেজি স্ত্রী মাছের জন্য ৮-১০ মিগ্রা. পিজি এবং পুরুষ মাছের জন্য ৪ মিগ্রা. পিজি বক্ষ পাখানার নীচে ইনজেকশন দিতে হবে। এক্ষেত্রে ইনজেকশন প্রয়োগের ১.০ মিলি. সিরিঞ্জ ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. পিজি ইনজেকশন দেয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে ১:১ অনুপাতে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার প্রবাহ দিতে হয়।

৬. সাধারণত হরমোন ইনজেকশন দেয়ার ৬-৭ ঘন্টা পর প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে ডিম দিয়ে থাকে। ডিম ছাড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব মাছগুলোকে সতর্কতা সাথে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

৭. তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে ২২-২৪ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয় এবং পরবর্তী ২-৩ দিন হাপাতেই রাখতে হয়।

৮. ডিম ফোটার ৬০ ঘন্টা পর্যন্ত রেণুপোনা কুসুম খালি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে থাকে। ষাট ঘন্টা পরে রেণু পোনাকে খাবার হিসেবে সিদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ৪ বার দিতে হবে এবং ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের ১০ টি স্ত্রী মাছের রেণুর জন্য একটি সিদ্ধ কুসুমের চার ভাগের এক ভাগ প্রতিবার সরবারহ করতে হয়।

৯. হাপাতে রেণু পোনাকে ২৪-৩৬ ঘন্টা খাওয়াতে হবে। এ অবস্থায় রেণু পোনাকে নার্সরি পুকুরে মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সতর্কতা : হরমোন প্রয়োগকৃত মাছ কোন অবস্থাতেই বাজারজাত করা ঠিক নয়।

কৈ মাছের নার্সারি বিবরণ

১. নার্সারি পুকুরের আয়তন ২০-৪০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হতে হবে।

২. প্রথমে পুকুরের তলা থেকে পঁচা কাদা উঠিয়ে ফেলতে হবে।

৩. নার্সারি পুকুরের চারপাশে ৩-৪ ফুট উঁচু মশারীর জালের বেষ্টনী দিতে হবে।

৪. অতঃপর পুকুরে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পূর্ণ করে (৩.০ ফুট উচ্চতা) প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি পরিমাণ চুন প্রয়োগ করতে হবে।

৫. চুন পয়োগের ০৩ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫.০ কেজি জৈব সারা পুকুরে দিতে হবে।

৬. জৈব সার প্রয়োগের পরের দিন প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ও ২০০ মিলি. চিটা গুড় পানিতে গুলে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।

৭. রেণু পোনা মজুদের ২৪ ঘন্টা পূর্বে গাঁস পোকা ও ক্ষতিকারক প্লাকটন বিনষ্ট করার জন্য ৮-১০ মিলি. সুমিথিয়ন প্রতি শতাংশে অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।

৮. পোনা মজুদের পূর্বে পুকুরের চারদিকে নাইলন জালের বেষ্টনী দিতে হবে।

৯. প্রস্ততকৃত পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম মজুদ করা যেতে পারে।

সারণি ১. কৈ মাছের রেণু পোনার খাদ্য সরাবারহের তালিকা:-

সময় কালরেণুর ওজনখাদ্যপ্রয়োগের নিয়ম
১-৪ দিন১০০ গ্রাম৩টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।দিনে তিন বার
৫-৮ দিন১০০ গ্রাম৩টি ডিম ও ৫০ গ্রাম আটার দ্রবণদিনে তিন বার
৯-১২ দিন১০০ গ্রাম৩০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবেদিনে তিন বার
১৩-১৭ দিন১০০ গ্রাম৪০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবেদিনে তিন বার
১৮-২৩ দিন১০০ গ্রাম৬০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবেদিনে তিন বার
২৪-৩০ দিন১০০ গ্রাম৭০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবেদিনে তিন বার
এভাবে নার্সারি করলে প্রতি কেজি রেণু হতে ২.০-২.৫ লক্ষ পোনা উৎপাদন করা সম্ভব।

উল্লেখ্য, কৈ মাছের নার্সারি পুকুরে রাতের বেলায় প্রায়ই অক্সিজেনের অভাব পরিলক্ষিত করা যায়। অক্সিজেনের অভাবের কারনে পোনার ব্যাপক মৃত্যু হতে পারে।

এ কারণে রেণু মজুদের ১ম দিন থেকে ০৫ দিন পর্যন্ত রাত্রে অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক ক্যামিকাল দ্রব্য ব্যবহার করা আবশ্যক। পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী রাতের বেলায় অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক ক্যামিকাল ব্যবহার করতে হবে।

কই মাছের চাষ পদ্ধতি (Koi Fish Culture)

পুকুর নির্বাচন

এ ব্যাপারে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। পুকুরে সারা বছর পানি থাকলেই হলো এবং শুকনো মওসুমে হাত দুই পানি থাকলে চলবে কারণ কই মাছ অন্য জিওল মাছের মত কাদার মধ্যে থাকতে পছন্দ করে।

তবে কই মাছ বৃষ্টির সময় পাড় বেয়ে আশেপাশের জলাশয়ে চলে যেতে পারে। সুতরাং পাড় খাড়া করতে হবে এবং সম্ভব হলে পাড়ের উপর ৫০ সে.মি. তারের বা পাকা বেড়া দিয়ে চতুর্দিকে ঘিরে দিতে হবে।

পুকুর প্রস্তুতি

১. কৈ মাছ চাষের জন্য ৪-৫ মাস পানি থেকে এ রকম ১৫-৫০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করতে হবে।
২. পুকুর শুকিয়ে অবঞ্চিত মাছ ও জলজ প্রাণি দূর করতে হবে।
৩. পোনা মজুদরে পূর্বে শতাংশে ১.০ কেজি হারে কলি চুল প্রয়োগ আবশ্যক। চুন প্রয়োগের ৫ দিন পরে পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।

পুকুরে মাছ ছাড়া

একবার মাছ ছাড়ার পর যদি মনে হয় কিছু সংখ্যক মাছ মরে গেছে তা হলে আর নতুন করে পোনা ছাড়ার প্রয়োজন নেই। কারণ ওরা বদ্ধ জলাশয়ে ডিম ছাড়ে এবং তা থেকেই সংখ্যায় বেড়ে যায়।

বিশেষ করে বৃষ্টিতে এদের শরীরে এক ধরণের শিহরণ সৃৃষ্টি হয় এবং দলে দলে চলাফেরা করার সময় পচা পাতা দুর্বা ঘাস, ডালপালায় স্ত্রী কই অল্প অল্প করে ডিম ছাড়ে এবং পুরুষ কই মাছ সে ডিমগুলো নিষিক্ত করে।

১৫-১৬ ঘন্টা পরে ডিম থেকে পোনা বেরিয়ে আসে। এভাবে একটি বয়স্ক স্ত্রী কই থেকে বছরে ৫ হাজার পোনা পাওয়া যায়।

যদি একক চাষ করা হয় এবং ছয় মাস পর কিছু মাছ পুকুর থেকে তুলে ফেলা হয় তবে এক সঙ্গে বিঘা প্রতি বিশ থেকে ত্রিশ হাজার চারা পোনা ছাড়লেও কোনো অসুবিধা হবে না কারণ দেখা গেছে যে এক বিঘা পুকুওে ২০,০০০-২২,০০০ পোনা মাছ অনায়াসে থাকতে পারে এবং এ থেকে ৫০০-৬০০ কেজি কই মাছ উৎপাদন সম্ভব।

পোনা মজুদ ও ব্যবস্থাপনা

১. প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ গ্রাম ওজনের সুস্থ-সবল ৩০০-৩৫০ টি পোনা মজুদ করতে হবে।

২. পোনা মজুদের দিন থেকে ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক পিলেট খাদ্য মাছের দেহ ওজনের ১৫-৪% হারে সকাল ও বিকালে পুকুরে ছিটিয়ে সরাবারহ করতে হবে।

৩. প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাবারের পরিমাল নির্ধারণ করতে হবে।

৪. কৈ মাছর পুকুরে প্রচুর প্লাংটনের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, এই প্লাংটন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি শতাংশে ৮-১০ টি মনোসেক্স তেলাপিয়া ও ২-৩ টি সিলভার কার্পের পোনা মজুদ করা যেতে পারে।

সম্পূরক খাদ্য

কই মাছ জলাশয়ে কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, রটিফার, অস্টাকড ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে। অনেক সময় এদেরকে জলাশয়ে সঞ্চিত জৈব পদার্থ খেতে দেখা যায়।

অনেকের মতে যে পুকুরে কই মাছ চাষ করা হয় এর উপরে কিংবা পাড়ে বাল্ব জালিয়ে রাতে আলোর ব্যবস্থা করলে রাতে পোকামাকড় আলোর দিকে ছুটে আসে এবং এদের কিছু কিছু মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ফলে মাছের উৎপাদন অপেক্ষকৃত ভাল হয়। তবে চাষ করে বেশি লাভ করার উদ্দেশ্য রোজ কিছুটা বাড়তি খাবার দেওয়া দরকার। এর পরিমান টা হবে বিঘা প্রতি এক থেকে দেড় কেজি। শুধু কই হলে দেহের ওজনের ৪%-৫%।

তবে তেমন কোন দামি খাবার দিতে হয় না। কাচাঁ গোবর চালের কুঁড়া এবং গমের ভুষি হলেই যথেষ্ট।

পুকুরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ছোট ছোট করে তাল পাকিয়ে খেতে দিতে পারা যায়।

এই তিনটি জিনিষ মিষানোর হার হবে –

  • কাঁচা গোবর -৬০ভাগ
  • চালের কুঁড়া -৩০ভাগ
  • গমের ভুষি -১০ভাগ

এক দেড় মাসের মধ্যে দুচারটি মাছ তুলে দেখতে হবে ওরা কেমন বাড়ছে। যদি দেখা যায় যে তেমন বাড়ছেনা তবে খাবারের পরিমান কিছুটা বাড়িয়ে দেয়া উচিত। বাইরে থেকে নাড়িভুঁড়ি, অখাদ্য মাংসের টুকরো দিয়ে এ মাছকে দ্রুত বড় করা যায়।

তবে চাষের মেয়াদ হলো ৭-৮ মাসের, তাই দেড় বছওে দুটো ফসল তোলা সম্ভব। ৭/৮ মাসে নয় গ্রাম ওজনের পোনার ওজন প্রায় ৫০ গ্রাম হওয়া উচিত।

মাছ আহরণ ও উৎপাদন

বর্ষার আগে সমস্ত মাছ ধরে বিক্রি করে ফেলা উচিত। কারণ বৃষ্টির পানি পড়লেই কই পুকুর থেকে উঠে পড়তে চায়। টানা জালেই পুকুরের অধিকাংশ মাছ ধরে ফেলা যায়। তবে বেশ কয়েক বার টানা জাল ব্যবহার করার পর সাধারণত ঐ জালে আর মাছ আসে না।

এই অবস্থায় খেপাল জাল ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়। এর পরেও পুকুর যদি আরও কিছু মাছ থেকে যায় তবে পাম্পের সাহায্যে পুকুরের পানি শুকিয়ে কাদায় লুকিয়ে থাকা অবশিষ্ট মাছ ধরে নিতে হয়।

আধা নিবিড় পদ্ধতিতে কৈ মাছ চাষ করলে ৪-৫ মাসের মধ্যে ৬০-৭০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এ সময় জাল টেনে এবং পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ পদ্ধতিতে ৫-৬ মাসে একর প্রতি ১০০০-২০০০ কেজি কৈ মাছ, ৫০০ কেজি গিফট তেলাপিয়া ও ২৫০-৩০০ কেজি সিলভার কার্প মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।

কৈ মাছের চাষ আয়-ব্যয়

এক একর জলাশয়ে ৪ মাসে ১.০-১.২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ১.৫-২.০ লক্ষ টাকা মনুফা অর্জন করা সম্ভব।

কৈ মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা

অপেক্ষাকৃত ভালো উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নি¤œবর্ণিত বিষয়সমূহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে:

১. পানির গুনাগুণ মাছ চাষের উপযোগী রাখার জন্য পিএইচ ৭.৫-৮.৫ ও অ্যামেনিয়াম ০-০.২ মিলি/লি. মাত্রায় রাখা আব্যশক। এ জন্য প্রতি ১৫ দিন পর পর চুন ২৫০-৩০০ গ্রাম/ শতাংশ পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া লবন ২০০-৩০০ গ্রাম/ শতাংশ হারে প্রতি মাসে পুকুরে ব্যবহার করতে হবে। পুকুরে পানির গুণাগুণ উপযোগী রাখার জন্য প্রয়োজনে বিশুদ্ধ পানি সরবারহ করতে হবে।

২. ভাল হ্যাচারি হতে পোনা সংগ্রহ করতে হবে এবং কোনভাবেই ক্রস ব্রেড পোনা ব্যবহার করা যাবে না। আগাম উৎপাদিত পোনা অর্থাৎ ফেব্রæয়ারি মাসে উৎপাদিত কৈ পোনা চাষে ব্যবহার করা যাবে না।

৩. নমুনায়ন করে মাছের সঠিক গড় ওজন নির্ধারণপূর্বক খাদ্য প্রয়োগ এবং সপ্তাহে ১ দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

৪. জৈব-নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসাবে পুকুরের চারদিকে এবং উপরে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার করতে হবে, ফলে রোগ জীবাণু সহজে এক পুকুর হতে অন্য পুকুরে সংক্রামিত হবে না। কৈ চাষের পুকুরে গরু, ছাগলের গোসল/ধৌত করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. পুকুর প্রস্তুতির পূর্বে বিøচিং পাউডার ১৫-২০ গ্রাম/শতাংশ হারে প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস হবে। চাষ কার্যক্রম শুরুর পূর্বে পুকুরের তলার জৈব মাটি ৪”-৬” উঠিয়ে ফেলতে হবে।

৬. মাছ চাষে উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন (Good Aquaculture Practice) অনুসরণ করতে হবে এবং প্রযুক্তি নির্ভর মাছ চাষ করতে হবে।

প্রায়শই জিজ্ঞাস্য (FAQs)

কই মাছকে ক্লাইম্বিং পার্চ কেন বলা হয়?

কই মাছ কানকো দিয়ে মাটিতেও চলাচল করতে পারে। এরা কেঁচোর সন্ধানে মেরুদণ্ড দিয়ে জমিতে হাঁটতে সক্ষম। কাক এবং ঘুড়ি তাদের আক্রমণ করে এবং গাছের উপর দেহগুলি নিয়ে যায়, এবং এইভাবে মাছটিকে ক্লাইম্বিং পার্চ বলা হয়, কারণ মাছটি গাছে উঠতে পারে।

কিন্তু মাছ গাছে উঠতে পারে না। অ্যানাবাস বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেনের উপর এতটাই নির্ভরশীল যে বাতাসে অ্যাক্সেস না থাকলে পানিতে রাখা হলে এটি শ্বাসরোধ হয়ে যায়। মাছ দীর্ঘ সময় ধরে পানির বাইরে থাকতে পারে।

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page