ধানক্ষেতে মাছ চাষ পদ্ধতি | Integrated Rice-Fish Farming

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ পদ্ধতি (Integrated Rice-Fish Farming) সারা বিশ্বে জলজ চাষের একটি জনপ্রিয় রূপ হয়ে উঠেছে। এই অনুশীলন গ্রামীণ কৃষকদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা এবং অতিরিক্ত আয় উভয়ই প্রদান করতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, মাটির উর্বরতা এবং জল ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে সাহায্য করার ক্ষমতার কারণে ধান ক্ষেতে মাছ চাষের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভাব্য সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, এই ধরনের চাষের সাথে সম্পর্কিত কিছু ঝুঁকিও রয়েছে।

তবে বিভিন্ন কারণে অতীতের তুলনায় বর্তমানে ধান ক্ষেত থেকে প্রকৃতিকভাবে জন্মানো মাছ ধরার পরিমাণ অনেক কমে গেছে। সুতরাং এই কারণেও ধান ক্ষেতে পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষের বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই নিবন্ধ ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সকল প্রয়োজনীয় বিষয়াদি বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা (Importance of Integrated Rice Fish Farming)

-ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করলে, মাছের জন্য আলাদা জায়গা দরকার হয় না, জমিও ভালো থাকে।

-মাছ ধানের চারার শিকড় খুচিয়ে খাবার অন্বেষণ করে, ফলে ধানের চারা আন্দোলিত হয়। ধানের ফলন ভালো হয়।

-ধান ক্ষেতে কীটপতঙ্গের উৎপাত কম হয়, যে সমস্ত কাটপতঙ্গ ধানের ক্ষতি করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

-অবাঞ্ছিত জলীয় আগাছা নিয়ন্ত্রন করা যায়।

-মাছের মল ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ ক্ষেতে সারের কাজ করে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের অসুবিধা/ঝুকি (Limitations or Disadvantages of Integrated Rice and Fish Farming)

-অনেক সময় ধান ক্ষেতে পানির গভীরতা মাছ চাষের জন্য অনুকুল নয়। অনেক দিন বৃষ্টি না হলে পানি শুকিয়ে মাছের অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে বা না শুকালেও ক্ষেতের পানি গরম হয়ে মাছের পক্ষে অসহনীয় হতে পারে।

আবার বেশি বৃষ্টি হলে, পানিতে ক্ষেতের পর ক্ষেত একাকার হলে মাছও পানির সঙ্গে ভেসে চলে যায়।

-ধান ক্ষেতে পানি ঘোলা থাকতে পারে যা মাছের জন্য সুবিধাজনক নয়।

-পানির অক্সিজেন অনেক সময় কমে যায় যা মাছের জন্য ক্ষতিকর।

-শৈবাল নষ্ট হয়ে পানি খারাপ হয়ে মাছ মাে যাবার উপক্রম হয়।

-পানি কম থাকার ফলে মাছ খেকো প্রানী মাছ নষ্ট করে দয়ে। জলসাপ ও অন্যান্য প্রাণীও মাছ নষ্ট করে ।

-ধান চাষির উপর বিশেষ চাপ পড়ে অধিকিন্তু ধানের জমি ছাড়তে হয়।

-মাছ রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

-ক্ষেত থেকে মাছ চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, কারণ সেখানে বিশেষ করে রাত্রে পাহারা রাখা সম্ভব নাও হতে পারে।

-যেহেতু খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাজারজাত করার মত মাচের মাছ প্রয়োজন সেহেতু ধান ক্ষেতে বড় মাপের পোনা ছাড়তে হবে, যা অনেক সময় পর্যাপ্ত পনিমাণে নাও পাওয়া যেতে পারে।

-বর্তমানে ধান ক্ষেতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। কিছ‚ রাসায়নিক সার ধানের পক্ষে হিতকর, কিন্তু মাছের জন্য ক্ষতিকর।

ধান ক্ষেতে আগাছা নাশ করার জন্য বিভিন্ন আগাছানাশক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার ধান চাষের ভাল হয় বটে কিন্ত তা মাছের জন্য মারাত্মক বিষ।

ধান ক্ষেতে কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার ধানকে রক্ষা করে কিন্তু এই ওষুধের সামান্যতম মাত্রায় সব মাছ মরে যায়।

-কাকড়া, ইদুর, ইত্যাদি প্রণী বাধের মধ্যে ছিদ্র করে ফেলে। এতে ধান ক্ষেতে পর্যাপ্ত পনিরমাণ পানি জমিয়ে রাখা সম্ভব হয়না।

-ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত ধান ক্ষেতের বাধ খুব উচু হয়না সুতরাং মাছ সহজেই বে হয়ে যেতে পারে যা কাম্য নয়। এসব খন্ডিত জমির চাষিরা বাধ উচু অথবা জমিতে গর্ত করতে আগ্রহী হয় না

ধানক্ষেতে মাছ চাষ পদ্ধতি | Integrated Rice-Fish Farming

বাংলাদেশের ধানক্ষেতের পরিমাণ প্রায় ২.৮৩ মিলিয়ন হেক্টর। ধান চাষের সময় ক্ষেতে পানি থাকা প্রয়োজন। ধান উঠানোর পরেও সেখানে অনেক সময় পানি থেকে যায় বা সেখানে অনায়াসে পানি প্রবেশ করানো এবং ধরে রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশের একসাথে ধানী জমিকে অস্থায়ী ও অগভীর পুকুর হিশেবে গন্য করা যেতে পারে। যেহেতু লোক সংখ্যার চাপের মুখে জমির সর্বাধিক এবং সর্বাত্মক ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় তবে অবশ্যই পরিবেশস্মতভাবে, সেখানে ধানী জমিতে মাছ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম।

ধান ক্ষেতে দুই ভাবে মাছ পাওয়া যেতে পারে, যথা, প্রকৃতিভাবে জন্মানো মাছ ধরে অথবা বৈজ্ঞানিকভাবে মাছ চাষ করে।

প্রথমোক্ত পদ্ধতিটি কোনো নতুন ব্যপার নয়। বহু প্রচীন কাল থেকেই ধান ক্ষেত থেকে মাছ ধরার প্রচলন রয়েছে।

বর্ষাকালে নানা ধরনের ছোট মাছ যেমন পুটি, ল্যাটা, কই, শিং, মাগুর, ছোট চিংড়ী ইত্যাদি অশেপাশের পুকুর/নদী/বিল থেকে এসে ডিম পাড়ে এবং আাপনা থেকেই জন্মায়।

ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ধান ক্ষেতের পানি নিকাশের মুখে আন্তা/বাশের ঘুনি পেতে গ্রামে ছেলে মেয়েদের এইসব মাছ সংগ্রহ করতে দেখা যায়।

অসুবিধা ও ঝুকি সত্বেও যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করে এবং অবস্থা চঝে ধান ক্ষেতে লাভজনকভাবে মাছ চাষ করা সম্ভব।

ধানক্ষেতে দুইভাবে মাছ চাষ করা হয়, যথা-

  • ধানের সঙ্গে চাষ
  • ধানের পরে মাছ চাষ

ধানের সঙ্গে মাছ চাষ (Simultaneous Culture)

মাঝারি ও নিচু অবস্থানের এটেল মাটিযুক্ত বড় মাপের ধানের জমি যেখানে বর্ষাকালে দেড় ফুট/৪৫ সে.মি. পানি থাকে ও পানি একেবারে শুকিয়ে যায় না এরকম ক্ষেতে মাছ চাষের পক্ষে বিশেষ উপযোগী।

ধানী জমিতে মাছ চাষ করতে হলে জমির চারদিকে দেড় ফুট উচু বাধ দিতে হবে এবং জমির ঢালু প্রন্তে ৪/৫ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট গভীর ভাল খনন করতে হবে।

খালটিকে সব সময় পানি ভর্তি রাখতে হবে। বিপদের সময় মাছেরা এই খালে আশ্রয় নেবে। সম্ভব হলে খালটিকে কাছাকাছি জলাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পরে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করলে কিটনাশক ওষুধ একেবারে প্রয়োগ না করাই ভাল। তবে পোকার উপদ্রব থাকলে চারাগুলিকে এক রাত্রি ০.১২ শতাংশ ফিরাউন ৩-জি দ্রবণে ডুবিয়ে জমিতে রোজণ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে কার্বানিল জাতীয় ওষুধ ধানী জমিতে প্রয়োগ করা যায়।

তবে ত্রক্ষেত্রে জমির পানি বের করে কেবল মাত্র খালে পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তখন মাছগুলো খালের আশ্রয় নেয়। ক্ষেতের আল দু-তিন দিন বাধা থাকে এবং তারপর খুলে দেওয়া হয়।

ধানের চারা রোপণের দিন খালে মাছ ছাড়া হয়। ৭-১০ দিনে পর ক্ষেতের আল খুলে দেয়া হয় যাতে ক্ষেতের পানি ও খালে পানি মিশে যায় এবং মাছগুলো খাল থেকে উঠে ধানের ক্ষেতে যথেচ্ছ বিচরণ কর খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে।

জমির পানি কমে গেলে খালে মাছেরা আশ্রয় নেয় এবং পরে খালের সঙ্গে যক্ত বড় জলাশায়ে মাছ চলে আসতে পারে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়। রবি চাষের সময় জমিতে আবারও ধান লাগানো যেতে পরে।

খালে সঞ্চীত পানির বেশ খানিকটা চাষের জন্য ব্যবহার করা যায়। ধান ক্ষেতের চার পাশের আলের জন্য কীটনাশক ওষুধ এবং রাসায়নিক সার খালের পানির সঙ্গে মিশতে পারে না।

এইভাবে ক্ষেত থেকে দু’বার ধান উৎপাদন করা সম্ভব এবং দশ মাসের মধ্যে ছয় মাস মাছগুলিকে ধান ক্ষেতে এবং রবি চাষের সময় একই ক্ষেতের খালের মধ্যে চার মাস পালন করা যায়।

ধান ক্ষেতে স্বাদু পানির প্রায় সব রকম মাছই চাষ করা যায়। তবে আমেরিকান রুই ও ঘেসো রুই ধান ক্ষেতে চাষ না করাই ভালো কারণ এরা ধান গাছের চারা ইত্যাদি খেয়ে ক্ষতি করতে পারে।

ধান ক্ষেতে চারা লাগানোর এক মাস পরে প্রতি হেক্টরে ১০০০ টি কাতলা, ৭৫০টি রুই, ৭৫০টি মৃগেল মাছের ছোট পোনা ছাড়া যেতে পারে। তবে ধান ক্ষেতে পোনা মাছের চেয়ে কই, শিং, মাগুর, ল্যাটা, শোল, ইত্যাদি, জিওল মাছের চাষই বেশি লাভজনক।

বিশেষ করে বৃহত্তর জেলায় লোনা জমিতে ধানের সঙ্গে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ চাষ করা হয়।ধান ক্ষেতে আপনা থেকেই জলজ উদ্ভিদ, শ্যাওলা, নানারকম পোকামাকড় জন্মায় এবং চারা মাছ এদরে খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে।

ধানের আগাছাও মাছের খাদ্য। পুকুরের চেয়ে ধান ক্ষেতে মাছ যে অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ে তা বিভিন্ন মাঠ পযায়ে গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। তবে উৎপাদন বাড়াতে হলে বাইরে থেকে পরিপুরক খাবার দিলে ভাল হয়।

এজন্য মাছের অনুমানিক ওজনের ২-২.৫ শতাংশ হারে ১ঃ১ অনুপাতে সরিষার খইল ও চালের কুড়ো মিশিয়ে মাছের খাবার হিশেবে প্রতিদিন ধানের ক্ষেতে দিতে হবে।

ধান ক্ষেতে শাচ ধরা খুবই সহজ। ধান ক্ষেত থেকে পানি বের হবার মুখে বাশের তৈরি ঘুনি/আস্তা বসিয়ে অনায়াসে মাছ ধরা যায়। তাছাড়া শীতকালে ধান কাটার সময় জমির পানি কমে খালের মধ্যে নেমে যায় এবং মাছগুলো তখন খালের পানিতে আশ্রয় নেয়।

ধানের পরে মাছ চাষ (Rotational Culture)

ধানের পরে মাছের চাষ ধানক্ষেতে মাছ চাষের পযায়ক্রমিক পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে একই জমিতে ধান ও মাছ একটির পর একটি উৎপন্ন করা হয়। এ ধরনের প্রযুক্তিতে ধান ও মাছ দুটোরই পরিপূর্ন যত্ন নেয়া সম্ভব হয়।

পযায়ক্রমিক পদ্ধতিতে ধান ও মাছ চাষে বেশ কতগুলো সুবিধা পাওয়া যায়। ধান ও মাছ বিভিন্ন সময়ে জন্মানো হয় বলে ধানক্ষেতে প্রয়োগ করা কীটনাশক থেকে মাছের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ভয় থাকে না।

মাছের শরীরে কীটনাশকজমে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। তাতে ঐ মাছ খেয়ে মানুষের ক্ষতি হতে পারে না। ধান ক্ষেতে প্রয়োজনমত কীটনাশক ব্যবহার করে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের মাধ্যমে ধানের ফলন বাড়ানো যায়।

ধানের পোকামাকড়ের জীবনচক্র ব্যাহত হওয়ার কারণে তাদের উপদ্রব এমনিতেও কম হয়ে থাকে। মাছ জন্মানো জন্য যেসব সার প্রয়োগ করা হয় সেগুলোর অনশিষ্ট বা অব্যবহৃত অংশ ধানের সাররূপে কাজে লাগাতে পারে।

ধানের খড়, গোড়া ইত্যাদি অংশগুলো পানিতে ডুবে থেকে পচে দিয়ে মাছের খাদ্য প্লাংকটনের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। একটি প্রচলিত পুকুর তৈরি করতে যত অর্থ ব্যয় হয়, এই পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে পানি ধরে রাখার ব্যয় ততটা হয় না।

ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা, ফুলবাড়িয়া ও ত্রিশাল থানা এবং বৃহত্তর ঢাকা, টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন বাইদ এলাকার মত প্রকৃতিক পরিবেশ বর্তমান সেখানে ধান ক্ষেতে ধানের পরে মাছ চাষ করা যায়।

বাইদ বলতে বুঝায় এমন সব জমি যেগুলোর আশপাশে উচু জমি থাকার কারণে সেগলোতে পানি জমে বোরো মৌসুমে ধান চাষ করা যায় এবং বোরো মৌসুমের পর পানি থেকে যায়। এসব জমিতে সচরাচর একটিমাত্র ফসল বোরো ধান উৎপাদন করা হয় এবং বছরের বাকি সময় ধরে পতিত থাকে।

এই ধরনের ক্ষেতে বা জলাশয়ের কিছু কিছ‚ ভৌত পরিবর্তন করলে এখানে সহজেই মাছের চাষ করা যেতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো অনেকটা ধানের সাথে মাছ চাষের বেলাতেও প্রযোজ্য।

এসব কাজকে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথা-

  • ১. ভৌত পরিবর্তন বা বাধ, গর্ত, নালা ইত্যাদি তৈরি
  • ২. ধানের চাষ
  • ৩. মাছের চাষ

১. ভৌত পরিবর্তন বা বাধ, গর্ত, নালা ইত্যাদি তৈরি

বাধ নির্মাণ

ক্ষেতের পারপাশের পাড় উচু হতে হবে। প্রয়োজন হলে বাধ তৈরি করতে হবে। এই পাড় বা বাধ উচু ও মজবুত হওয়া দরকার, যাতে বর্ষাকালে বাধ উপচে দিয়ে পানি বের হতে অথবা বাইর থেকে এসে ঢুকতে না পারে।

কাজেই পাড় নিচু থাকলে তা অবশ্যই উচু করতে হবে। পাড় ভাঙ্গা থাকলে তা সংস্কার করতে হবে। এসব কাজ বর্ষা মৌসুমে আগেই শেষ করা ভালো।

গর্ত খনন

ক্ষেতের পানি কমে গেলে কিংবা গরম হয়ে উঠলে যেতে মাছগুলো গভীর পানিতে ও ঠান্ডা পরিবেশে আশ্রয় নিতে পরে, সেজন্য ক্ষেতের মধ্যে কয়েকটি গর্ত থাকা দরকার।

এই গর্তও বর্ষা মৌসুমের আগে ক্ষেত অনেকটা শুকনা থাকা অবস্থায় খুড়ে নিতে হবে।

নির্গমন নালা তৈরি

মাছের স্বাভাবিকভাবে অবস্থান, চলাফেরা ও বৃদ্ধির জন্য পানির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গভীরতা বজায় রাখা দরকার। এই গভীরতা ১০০-১৫০ সেন্টিমিটার বা ৩-৫ ফুট হওয়া উচিত।

বর্ষাকালে যখন পনি বেড়ে যায় তখন যেন অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে সেজন্য নিগর্মন নালা তৈরি করতে হয়। এই নালা বা ফাকা পাড়ের একন জায়গায় ও উচ্চতায় খনন করতে হবে, যেন খরা মৌসুমে ক্ষেতে বা পুকুরে ১-১.৫ মিটার পানি থাকে।

এই নালা দিয়ে আবার প্রয়োজনমত পানি ঢুকানো যাবে। এই নালার ব্যস ২-৩ ফুট বা ৬০-৯০ সেন্টিমিটার হতে পারে।

জাল বা বানা স্থাপন

যাতে নিগর্মন বা অগমন নালার পানির সাথে ক্ষেতের মাছ বেরিয়ে যেতে কিংবা বাইরের অযাচিত মাছ ঢুকতে না পরে সেজন্য নালার মুখে বাশের বানা এটি দিতে হবে।

২. ধানের চাষ

ধানের জাত ও মৌসুম

আধুনিক জাতের যেসব ধান বোরো মৌসুমের জন্য উপযুক্ত, এই প্রযুক্তিতে সেগুলোর মধ্য হতে য কোনটি ব্যবহার করা যেতে পরে। আবার স্থানীয় জাতের ধানও চাষ করা যায়।

বোরো মৌসুমই এই প্রযুক্তির ধানের ঋতু। সাধারণত পৌষ-মাঘ মাস বা ডিসেম্বর-জানুয়ারী ধঅনের চারা রেপণ এবং বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস বা এপ্রিল-মে মাস ধান কাটার সময়।

চারা রোপণ

ধান চাষের যে প্রচলিত পদ্ধতি সেই আনুসারে ২০-২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে এক সারিতে ১৫-২০ সেন্টিমিটার ব্যবধানে চারার গাছ রোপণ করা হয়।

ধান ক্ষেতের পরিচর্যা

বোরো ধান উৎপাদনের জন্য প্রচলিত কাজকর্ম, যথা, পর্যায়ক্রমে জমি শুকানো, ইউরিয়া সার প্রয়োগ তিন মিস্তিতে ও আগাছা দমন, জমি ভিজানো, পোকা-মাকড় ও রোগ বালাই দম ইত্যাদি যথানিয়মে করে যেতে হবে। প্রয়োজনমত রোগ ও কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ধান কাটা

স্বাভাবিক সময়ে ধান কাটা হবে। তবে ধানের পরে যাতে মাছ চাষ সুবিধা হয় সেজন্য ক্ষেতে ধান গাছের গোড়া নাড়া ইত্যাদি বেশি পরিমাণে থাকতে হবে।

তাহলে এসব জৈব পদার্থ পচে দিয়ে পরবর্তী সময়ে মাছের খাদ্য প্লাঙ্কটন জন্মাতে সুবিধা হবে।

৩. মাছের চাষ

মাছের জাত

ধানের পরে মাছ জন্মানো হয় জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক / অগ্রহায়ণ পযর্ন্ত সময়ে অর্থাৎ পুরো বর্ষা ও শরৎকাল ধরে মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায়।

ঐ সব ডোবাও বর্ষাকালে পানিপূর্ন হয়ে যায়। এজন্য ঐ ধরনের সব জায়গায় বোরো ধানের পরে বহু প্রজাতির মাছ জন্মানো যেতে পরে।

যথা, রাজপুটি, তেলাপিয়া, নাইলোনটিকা, মিরর কার্প, রুই মৃগেল, কাতলা, সিলভার কার্প, ও চিংড়ি। তবে সরপুটি, নাইলোটিকা, মিরর কার্প ও অন্যান্য জাতের কার্পিও মাছকে সবচেয়ে বেশী উপযোগী চলে বিবেচনা করা হয়।

মোটামুটিভাবে বলতে গেলে জ্যৈষ্ঠ/মে-জুন মাস পোনা ছাড়ার উত্তম সময়। পোনা ছাড়ার ভাল সময় সকাল ও বিকেল বেলা।

পোনার পাত্র পানিতে আধা ডুবন্ত অবস্থায় ধরে রাখার পর যখন পাত্রের পানির তাপমাত্রা ক্ষেতের বা পুকুরের পানির সাথে সমান হয়ে যাবে, তখন পাত্র একটু কাত করে পোনা গুলোকে পানিতে ছেড়ে দেয়া হয়।

এই সময়ে জমিতে ৩০-৬০ সেন্টিমিটার পানি থাকা প্রয়োজন।

পরিচর্যা

ক্ষেতে বা পুকুরে যে সার প্রয়োগ করা হয় সেগুলোর কারণে পানিতে মাছের জন্য প্লাঙ্কটন জাতীয় প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মায়। তবু মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কিছু সম্পূরক বা বাড়তি খাদ্যও সরবরাহ করা যেতে পারে।

প্রতি মাসে একবার করে পুকুরে মাছের আনুমানিক ওজন যত হবে তার ৫% পরিমাণে চালের জুড়া কিংবা গমের ভূষি পানিতে ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।

সম্পূর্ন খাবারগুলো কুড়া কিংবা ভূষিতে সীমাবদ্ধ রেখে যদি তার অন্তত এক চতুর্থাংশের পরিবর্তে সরিষার খৈল প্রয়োগ করা হয় তাহলে তা বেশি ভালো হবে।

ক্ষেতের পানিতে যেন ভালভাবে সূর্যের আলো পড়ে সেজন্য পাড়ের উপরে হায়াদানকরী উচু গাছপালা কম থাকা বা না থাকা উচিত। পানিতে বেশি পরিমাণে শ্যাওলাজাতীয় আগাছা থাকলে তা তুলে ফেলতে হবে।

এই ক্ষেতে বা পুকুরে যেন কীটনাশক ছিটানো শস্যের ক্ষেত থেকে পানি না আসে সেদিকে নজর রাখতে হবে।

মাছ ধরা

মাছ ছাড়ার পাচ মাস পরে, কর্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ক্ষেতের বা ডোবার পানি কমে এলে মাছ ধরার ব্যবস্থ করা যাবে।

মাছ ধরার জন্য টানা বেড় জাল খুবই উপযোগী। ভোররাতে থেকে খুব সকাল বেলা পযর্ন্ত মাছ ধরার আদর্শ সময়।

মাছের ফলন

সঠিকভাবে চাষ করলে প্রতি হেক্টর ক্ষেতে সরপুট, মিরর কার্প, রুই ইত্যাদি মাছ মিলিয়ে ৭৫০-১০০০ কেজি মাছ উৎপন্ন হতে পারে।

পোনা মজুদের পরিমাণ

কতগুলো পোনা হবে তা নির্ভর করে মাছের জাত ও তার আকারের উপর। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, পানিতে যেন মাছের খাদ্যের অভাব না ঘটে।

কমন কার্প/সাইপ্রিনাস কার্পিও, মিরর কার্প, সিলভার কার্প ইত্যাদির বেলায় কম সংখ্যার এবং নাইলোনটিকা কিংবা সরপুটি ধরনের অনুপাতিকভাবে ছোট আকারে মাছের বেলায় বেশি সংখ্যায় ছাড়া যেতে পারে।

শেষ কথা

মাছ চাষ এশিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অংশের অনেক গ্রামীণ কৃষকদের আয় উপার্জনের একটি দুর্দান্ত উপায়। এটি জমি ব্যবহার করার একটি দক্ষ এবং লাভজনক উপায় যা অন্যথায় কম ব্যবহার করা হবে।

ধান ক্ষেত মাছ চাষের জন্য আদর্শ, কারণ এগুলি মাছের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত স্থান এবং জল সরবরাহ করে। তাছাড়া, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা পানির বিদ্যমান উৎসগুলোকে কাজে লাগিয়ে পানির অপচয় কমাতে সাহায্য করতে পারে।

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page