অধিক লাভজনক সমন্বিত মুরগি ও মাছ চাষ পদ্ধতি (Integrated Poultry Fish Farming ‍System)

সমন্বিত মুরগি ও মাছ চাষ পদ্ধতিতে (Integrated Poultry Fish Farming ‍System) পুকরের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় এবং একই ব্যবস্থাপনায় লাভজনকভাবে মাছ, ডিম ও মাংস উৎপাদন সম্ভব।

বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছোট বড় পুকুর রয়েছে এবং প্রতিটি বাড়িতেই চাষিরা অল্প বিস্তর মুরগি পালন করে থাকেন। সাধারণত এসব মুরগির বিষ্ঠা কোনো উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহার করা হয় না।

অন্যদিকে নিবিড় মাছ চাষের সমুদয় পরিচালনা ব্যয়ের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগই খরচ হয় বাইরে থেকে সরবরাহকৃত সার ও খাবারের পেছনে।

সমন্বিত মুরগি ও মাছ চাষ পদ্বতিতে মুরগিকে যে খাবার দেয়া হয়ে থাকে তার উচ্ছিষ্ট এবং মুরগির বিষ্ঠা পুকুরে সরাসরি পড়ার ফলে আর কোনো সার বা খাবার ছাড়াই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাছ উৎপাদন করে বাড়তি আয় করা সম্ভব।

তাছাড়া পুকুরের তলার পচা মাটি পুকুরের পাড়ে সার হিসেবে ব্যবহার করে সব্জি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

বলা বাহুল্য এ পদ্ধতিতে মুরগির ঘর পুকুরের উপরই তৈরি করা হয়ে থাকে। অনেকে পুকুরের পাড়েও মুরগির ঘর তৈরি করে থাকে। তবে বিভিন্ন সুবিধাদির বিবেচনায় পুকুরের উপরে মুরগির ঘর নির্মাণ করাই শ্রেয়।

পুকুরে মাছ ও মুরগির সম্বনিত চাষ পদ্ধতির সুবিধা (Benefits of Integrated Poultry Fish Farming ‍System)

এই পদ্ধতির সুবিধা,

– মুরগির বিষ্ঠা একটি উৎকুষ্ট সার যা মাছের প্রাকৃতিক খাবার তৈরিতে সাহায্য করে। সুতরাং আলাদা কোনো সারের প্রয়োজন নেই।

– পুকুরের উপর তৈরি ঘরে মুরগি পালন করলে মাছ উৎপাদনের জন্য সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। অব্যবহৃত ও পানিতে পড়ে যাওয়া মুরগির খাদ্য মাছের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

– পুকুরের উপর ঘর তৈরি করলে মুরগি পালনের জন্য আলাদা কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না।

– মাটির সংস্পর্শে থাকেন বলে মুরগির রোগ বালাই ও কম হয়।

– মুরগির বিষ্ঠা সরাসরি পানিতে পড়ে তাই সব সময় ঘর পরিষ্কার না করলেও চলে। তবে যেহেতু পানির উপরের অবস্থিত সুতরাং মুরগির ঘর সহজেই বালতি দিয়ে পুকুরের পানি তুলে সাফ করা যায়।

মুরগির ঘর নিয়মিত সাফ করা উচিত। এতে মুরগির যেমন স্বাস্থ্য ভাল থাকে অন্যদিকে আপনাআপনি মাছের খাবার ও সার জোগাড় হয়ে যায়।

– মুরগির ঘর পুকুরের উপর অবস্থিত বলে মুরগির বিষ্ঠা ও উচ্ছিষ্ট খাবার সরাসরি পানিতে পড়ে সুতরাং কোনো কিছুই অপচয় হয় না। পাড়ে নির্মিত মুরগির ঘরের এসব সুবিধা নেই।
আমরা আমাদের আলোচনা দু’ভাগে বিভক্ত করবো।

প্রথমে আমরা মুরগি পালনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরবো। পরে আমরা বিস্তারিতভাবে মাছ চাষের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি বর্ণনা করবো।

সমন্বিত মুরগি ও মাছ চাষ পদ্ধতি (Integrated Poultry Fish Farming ‍System)

মুরগি পালন পদ্ধতি

মুরগির ঘর নির্মাণ

মুরগির ঘর খোলামেলা জায়গায় হওয়া উচিত এবং ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ঢুকতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। মুরগির ঘরের আয়তন কত হবে তা নির্ভর করে ঐ ঘরে কতগুলি মুরগি পালা হবে তার উপর।

সাধারণত প্রতিটি ব্রয়লার (মাংস উৎপাদনকারী) মুরগির জন্য ১ থেকে ১.৫ বর্গফুট এবং ডিম পাড়া মুরগির জন্য ২ থেকে ২.৫ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হয়।

পুকুরের উপর তৈরি মুরগির ঘরের মেঝে বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি করতে হবে এবং মেঝেতে পাতা দুটো বাতার মাঝে দূরত্ব আধা ইঞ্চির চেয়ে একটু কম হওয়া উচিত যাতে বাতার ফাঁকে মুরগির পা না আটকে যায় আবার ফাঁক দিয়ে মুরগির বিষ্ঠা ও উচ্ছিষ্ট খাবার সরাসরি পানিতে পড়তে পারে।

মুরগির ঘর পাড়ের মাঝামাঝি জায়গা বরাবর হওয়া উচিত। ঘর আয়তাকার হওয়া দরকার এবং পাড় থেকে ৩ ফুট দূরে হতে হবে যাতে শুকনো মৌসুমে পানি কমে গেলেও মুরগির বিষ্ঠা ও উচ্ছিষ্ট খাবার মাটিতে বা ডাঙ্গায় না পড়ে।

ঘরের মেঝে এমনভাবে করতে হবে যাতে বর্ষা ও বন্যার সময় মেঝে পানিতে ডুবে না যায়। দীর্ঘ স্থায়ীত্বের জন্য দোচালা করাই ভাল। ঘরের মেঝে থেকে চার ফুট উঁচুতে চালা করতে হবে।

ঘরের চারিদিকে আড়াই ফুট উচ্চতা (মেঝে থেকে) পর্যন্ত বাঁশের শক্ত চাটাই দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। চাটাইয়ের উপর থেকে চালা পর্যন্ত চতুর্দিক দেড় ফুট করে এমনভাবে বাঁশের তরজা দিয়ে ঢুকে মুরগির ক্ষতি করতে না পারে।

মুরগির জন্য ছনের ঘরই উত্তম। এতে শীত এবং গ্রীম্ম উভয় ঋতুতেই তাপমাত্রা সহনশীল থাকে। মুরগির ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস থাকতে হবে যাতে ধুলোবালি এবং বিষাক্ত গ্যাস মুরগির ক্ষতি না করতে পারে। মুরগি পালনের জন্য বাজারে যেসব তৈরি খাঁচা পাওয়া যায় সেগুলোও পুকুরের উপর ব্যবহার করা যেতে পারে।

মুরগির প্রজাতি নির্বাচন

সাধারণত মাংস ও ডিম উৎপাদন এ দুই উদ্দেশ্যেই মুরগি পালন করা হয়ে থাকে। মাংস উৎপাদনকারী মোরগ-মুরগিকে ‘ব্রয়লার’ ও ডিমপাড়া মুরগিকে ‘লেয়ার’ বলা হয়।

অল্প সময়ে ও অল্প খরচে বেশি মাংস উৎপাদনের জন্য শেভার স্টারব্রো-১৫ মুরগিই উত্তম। অগ্রিম যোগাযোগ করে এই জাতের মরুগির বাচ্চা বিমান পোলট্রি কমপ্লেক্স, গনকবাড়ি, সাভার, ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা যায়।

বেশি ডিম উৎপাদনের জন্য স্টার ক্রস, ইসা ব্রাউন, ইসা ব্যববকক, লোম্যান, হাইসেক্স হোয়াইট লেগহর্ণ ও আর.আই.আর. জাতীয় লেয়ার মুরগি নির্বাচন করা যেতে পারে।

ঢাকার বাইরে এসবের প্রাপ্তিস্থানের তথ্যের জন্য স্থানীয় থানা পশু পালন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেসরকারি খাতে অনেক উন্নতমানের মুরগির খামার তৈরি হয়েছে।

তাচাড়া এন.জি.ও নেতৃত্বেও বেশকিছু উন্নতমানের মুরগির খামার রয়েছে। এদের কাজ থেকেও মুরগির নেয়া যেতে পারে।

মুরগির সংখ্যা

প্রতি বিঘা পুকুরের উপর ৬০-৬৬টি মুরগি পালন করলে মাছ উৎপাদনের জন্য কোনো প্রকার সার, খাদ্য সরবরাহের প্রয়োজন হয় না। মুরগির এই ঘনত্বে পুকুরের পানি দূষিত হয় না বলে পারিবারিক অন্যান্য কাজেও পানি ব্যবহার করা যায়।

মুরগির খাবার ও খাওয়ানোর পদ্বতি

ব্রয়লার মুরগির মাংস বৃদ্ধির জন্য এবং ডিমপাড়া মুরগির ডিম উৎপাদনের হার বৃদ্ধির জন্য মুরগিকে অবশ্যই খাদ্য দিতে হবে। নিচে ব্রয়লার ও ডিমপাড়া মুরগির আদর্শ সুষম খাদ্যের

সর্বদা টাটকা শাকসব্জি মোরগ মুরগিকে খাওয়াতে হবে। প্রতিটি ডিমপাড়া (লেয়ার) মুরগিকে প্রতিদিন ১১৫-১২৫ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে। অন্যদিেেক প্রতিটি ব্রয়লার মুরগিকে প্রতিদিন ১১০-১২০ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে।

যেহেতু ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদন সুষম খাদ্যের উপর নির্ভরশীল সেহেতু এদের খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য মজুদ রাখতে হবে।

মুরগি যত্ন

বাচ্চা অবস্থায় মুরগির বিশেষ যত্ন নেওয়া দরকার। এক মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চা মুরগির শরীরে কিছুটা তাপ দেয়ার প্রয়োজন হয়। সাধারণত ১ থেকে ১৪ দিন বয়স পর্যন্ত ৮৫ ডিগ্রি হতে ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং ১৫ থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত ৭৫ ডিগ্রি ফারেহাইট তাপমাত্রায় প্রয়োজন হয়।

বাচ্চার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রার পরিমাণও কমতে থাকে এবং শীতকালে প্রায় ১ মাস ও গ্রীম্মকালে প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন বয়সে মুরগির বাচ্চা পরিবেশেরর তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।

বৈদ্যুতিক বাল্ব, টিনের হিটার বা হারিকেনের আলো জ¦ালিয়ে বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় তাপের ব্যবস্থা করা যায়। এক মাস পর্যন্ত প্রতিটি ব্রয়লার ও ডিমপাড়া মুরগির বাচ্চার জন্য ৯ বর্গইঞ্চি জায়গার প্রয়োজন হয়। বাচ্চা পালনের আলাদা কোনো জায়গা না থাকলে এ সময়ের জন্য ঘরের মধ্যে বেড়া দিয়ে বাচ্চার সংখ্যা অনুপাত মুরগির বাচ্চা পালন করা যায়।

৬০ থেকে ৬৬টি বাচ্চার জন্য ২টি ২০০ ওয়াটের বাল্ব অথবা ১টি টিনের হিটার অথবা ২টি হারিকেন জালিয়ে প্রয়োজনীয় তাপের ব্যবস্থা করা যায়। টিনের হিটারের ভেতর তুষ ব্যবহার করা হয় এবং তুষের আগুন থেকে তাপ উৎপন্ন হয়।

মুরগির ঘর সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঝড় বৃষ্টির সময় যাতে মুরগি না ভিজে যায় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। শীতের সময় মুরগি যাতে ঠান্ডায় কষ্ট না পায় অথবা কুয়াশা ঘরে ঢুকে মুরগির ঠান্ডা না লাগে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে মুরগি স্বাভাবিকভাবে খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা ইত্যাদি করছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে। অস্বাভাবিক কোনো কিছু মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

খাবারদানি ও পানির পাত্র

২ থেকে ৩ ফুট লম্বা, ৯ ইঞ্চির চওড়া এবং ৪ ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট কাঠ দিয়ে তৈরি খাবার পাত্রে ২৪ টি মুরগি দুইদিক হতে সহজেই খেতে পারে। মুরগি ছোট থাকা অবস্থায় খাবার পাত্র ছোট থাকা উচিত।

১৪ দিন বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চাকে বাঁশের অথবা টিনের তৈরি ট্রেডে খাদ্য দিতে হবে। ১ হতে ১.৫ ফুট আকারের একটি ট্রেতে ৫০টি মুরগির বাচ্চাকে একসঙ্গে খাবার দেয়া যেতে পারে। বাজারে এ ধরনের খাবার পাত্র কিনতেও পাওয়া যায়।

খাবার দেওয়ার সময় অবশ্যই পাত্রের তিন ভাগের এক খালি রাখতে হবে। খাবার পাত্রটি পুরো ভর্তি করে দিলে অনেক খাবার অপচয় হয়।

মুরগির ঘরে পানির পাত্রে অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি থাকতে হবে। গ্রামীণ পরিবেশে ছোট মাটির কলসির উপরিভাগের পাশে ছোট ছিদ্র করে পানি সমেত কলসিটিতে পানির পাত্রের উপর উল্টিয়ে দেয়া যায়।

উল্টানো কলসি বা টিনের কৌটার ছিদ্র পথে পানি ধীরে ধীরে পাত্রে এসে জমা হলে মোরগ-মুরগি সে পানি পান করতে পারে। ব্রয়লারের ক্ষেত্রে প্রথমি দিন হগতে প্রতি ৫ দিন অন্তর পানির সঙ্গে ভিটামিন খাওয়াতে হবে।

আলো

ব্রয়লার মুরগি রাত-দিন সব সময় খাবার খেয়ে থাকে। তাই ব্রয়লার মুরগির ঘরে সারারাত আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। ডিমপাড়া মুরগির জন্য মোট ১৬ ঘন্টা আলোর প্রয়োজন হয়।

মুরগির রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা

রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে দু’টি সাধারণ সূত্র সব সময়ে মনে রাখা প্রয়োজন

মুরগির পালন পদ্ধতি সঠিক হলে রোগের আক্রমণ কম হবে।

চিকিৎসা করে রোগ ভাল করার চেয়ে রোগের প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়াই উত্তম। সুতরাং মুরগিকে সঠিক সময়ে বিভিন্ন রোগের টিকা দিতে হবে। তুলনামূলকভাবে ব্রয়লার মুরগি রোগাক্রান্ত কম হয়।

মুরগির রোগের চিকিৎসা

একবার রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে, অবশ্যই সাধ্যমত মুরগির চিকিৎসা করাতে হবে।
চিকিৎসাগুলি হলো,

রাণীক্ষেত-এই রোগের কোনো চিকিৎসা নাই। অসুস্থ মুরগিকে অবশ্যই আলাদা করতে হবে।

মুরগির বসন্ত-রোগ হলে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট পানিতে মিশিয়ে অথবা স্যাভলন দিয়ে বসন্তের গুটিগুলো মুছে দিতে হবে।

মুরগির কলেরা-রোগ দেখা দিলে কসুঝিক প্লাস পর পর তিন দিন পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে অথবা টেরামাইসিন ইনজেকশন দিতে হবে।

কৃমি-কৃমির দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতি মাসে একবার ইউভিলন, এভিপার ইত্যাদি পানি বা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।

ককসিডিওসিম বা রক্ত আমাশয়-রোগ দেখা দিলে ৫ মাস এস.বি ৩০% বা এমবাজিন তিন লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।

মাছ চাষ পদ্ধতি

পুকুর প্রস্তুতি

পুকুর প্রস্তুতি বলতে প্রধানত পুকুরে মাছের জন্য যেসব ক্ষতিকর প্রতিযোগী প্রাণী ও পদার্থ থাকে সেগুলোর অপসারধ বা ধ্বংস, পারিপাশিক অবস্থার উন্নয়ন, চুন দ্বারা মাটি ও পানি শোধন এবং মাছের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি করাকে বুঝায়।

এ প্রস্তুতির ওপর মাছ চাষের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে। পুকুরে মাছের জন্য ক্ষতিকর/প্রতিযোগী প্রাণী ও পদার্থ বলতে নানা ধরনের রাক্ষুসে ও ছোট মাস, পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ, জলজ আগাছা, পুকুরের তলার আবর্জনা, নানা প্রকার বিষাক্ত গ্যাস ও রোগ জীবাণু ইত্যাতিকে বুঝায়।

পুকুরের পানি নিষ্কাশনের সুবিধা থাকলে প্রথমেই পুকুরের পানি সরিয়ে পুকুর হতে রাক্ষুসে মাছ (শোল, বোয়াল, গজার,আইড়, টাকি, ফলি প্রভৃতি) এবং ছোট মাছ (বেলে পুঁটি, দাড়কিনা, মলা, চেলা, চাপিলা, ঢেলা, চান্দা প্রভৃতি) ফেলতে হবে।

বার বার জাল টেনে রাক্ষুসে ও ছোট মাছ যতদুর সম্ভব সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।

পুকুরে জলজ আগাছা থাকলে শিকড়সহ তা তুলে ফেলতে হবে। রাক্ষুসে ও ছোট মাছ ও আগাছা অপসারণের পর পুকুরের তলদেশে খুব বেশি কাদা, পচা পাতা প্রভৃতি থাকলে তাও সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।

পুকুরের তলদেশ আসমান, পাড় গর্তযুক্ত, ভাঙ্গা বা নিচু থাকলে তা সমান করে নিতে হবে। পুকুর পাড়ে ঘন গাছপালার জন্য পুকুরে যাতে আলো বাতাস বাধা না পায় তার ব্যবস্থাও করতে হবে।

পুকুরে সূর্যের আলো না পড়লে কিংবা কম পড়লে মাছের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। বাতাসযুক্ত ও খোলামেলা পুকুর মাছ চাষের জন্য খুবই উপযোগী।

পুকুরে বিভিন্ন রোগের জীবাণু, বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি মাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। চুন প্রয়োগ করে এগুলো দূর করা যায়। তাছাড়া পানিতে চুন প্রয়োগ না করলে মাছের খাদ্য জন্মানো যায় না।

তাই পুকুর হতে পানি নিষ্কাশনের পর বিঘা (৩৩ শতাংশ) প্রতি ২৫ কেজি চুন সমস্ত পুকুরের তলায় ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব না হলে বিঘা প্রতি ৩৩ কেজি চুন পানিতে গুলে সারা পুকুর ছিটিয়ে দিতে হবে।

পুকুরে যদি বিষ প্রয়োগ করা হয় তাহলে প্রয়োগের ৭ দিন পর চুনা ব্যবহার করতে হবে এবং চুন ব্যবহারের ৭ দিন পর পুকুরের উপর নির্মিত ঘরে মুরগির বাচ্ছা মজুদ করতে হবে। বাচ্চা মজুদের ১০ থেকে ১২ দিন পর পুকুরে মাছ ছাড়তে হবে।

মাছের প্রজাতি নির্বাচন

সমন্বিত মাছ ও মুরগি চাষের পুকুরের জন্য মাছের প্রজাতি নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের খামার পদ্ধতির পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির এমন সব মাছ ছাড়তে হবে যারা পুকুরে তৈরি খাবারের জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে না।

পুকুরে মাছের জন্য বিভিন্ন রকমের খাদ্য তৈরি হয়, যেমন ক্ষুদে উদ্ভিদ (ফাইটোপ্লাংকটন), ক্ষুদে প্রাণী (জুপ্লাংকটন), জলজ পোকামাকড় ইত্যাদি। পুকুরে এমন সব প্রজাতির মাছ ছাড়তে হবে যেগুলো পুকুরে তৈরি এ সমস্থ খাবার খেষে শেষ করে ফেলবে।

এতে স্বভাবতই মাছের উৎপাদন বেশি হবে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছাড়লে পুকুরে উৎপাদিত খাদ্যসমূহের যথাযথ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং মাছের উৎপাদন বাড়বে।

শুধু একটি প্রজাতির মাছ ছাড়লে এরা এক ধরনের খাদ্যই খাবে এবং পুকুরে উৎপাদিন খাদ্যের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার হবে না। ফলে মাছের উৎপাদন কম হবে।

সমস্বিত পদ্ধতিতে মাছ চাষের বেলায় পুকুরের তলায় সঞ্চিত খাবার খায় এমন একটি প্রজাতির মাছ পুকুরে অবশ্যই থাকা উচিত। কারণ মুরগি পালিত পুকুরের তলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছের খাদ্য জমা হয়।

মৃগেল, কালবাউস এবং মিররকার্প বা কার্পিও জাতীয় মাছ পুকুরের তলার খাবার খেয়ে থাকে এবং একই সাথে তলার মাটি নাড়াচাড়া করে মাটিতে জমে থাকা সারবস্ত পানিতে মিশিয়ে দেয়। ফলে পানির উৎপাদিকা শক্তি বেড়ে যায়।

পুকুরের পানির স্তরের মধ্যভাগের খাদ্যসমৃহের জন্য দেশি রুই এবং উপরিভাগের জন্য কাতলা অথবা সিলভার কার্প মাছ দিতে হবে। গ্রাসকার্প মাছেল প্রধান খাদ্য ঘাস ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ।

পুকুরে জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণে গ্রাসকার্প মাছ খুবই সহায়ক। তাছাড়া পুকুর পাড়ে উৎপাদিত ঘাসের যথাযথ ব্যবহারের জন্যও পুকুরে গ্রাস কার্প মাছ ছাড়া দরকার।

গ্রাসকার্প যেহেতু ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ খেয়ে থাকে সেজন্য পুকুরে জলজ আগাছা না থাকলে পুকুর পাড়ে জন্মানো ঘাস, পাতা ইত্যাদি কেটে পুকুরে দিতে হবে। পুকুর পাড়ে এ জন্য নেপিয়ার, গিনি, পারা প্রভৃতি উন্নত জাতের ঘাস লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়।

প্রতিদিন গ্রাসকার্প জাতীয় মাছের ওজনের শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ঘাস মাছ কে খেতে দিতে হবে। গ্রাস কার্প যেহেতু প্রচুর গাস ও জলজ আগাছা খায় সেজন্য এদের পরিত্য্যাক্ত মল পুকুরে পুনরায় সার হিসেবে রুপান্তিরিত হয়ে অন্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

সমন্বিত মাছ ও মুরগি চাষ পদ্ধতিতে মাছের ছাড়ার জন্য কাতলা, সিলভার কার্প, রুই, মৃগেল, গ্রাস কার্প, মিররকার্প/কার্পি ও মাছ নির্বাচন করা যেতে পারে। এছাড়াও প্রতি শতাংশে ১০-১৫ টি রাজপুঁটি মাছের পোনা ছাড়া যেতে পারে।

মাছ ছাড়ার হাড় ও ঘনত্ব

প্রতি বিঘা পুকুরে ৭৫০ থেকে ৮০০টি, ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি আকারের পোনা ছাড়া যেতে পারে। বেশি উৎপাদনের জন্য পুকুরে নিম্মোক্ত হারে মাছ ছাড়া উচিত। সমন্বিত পদ্ধতিতে এই হারে মাছ ছাড়লে গ্রাস কার্প ছাড়া অন্যান্য মাছের জন্য বাইরে থেকে কোনো খাবার দেয়ার প্রয়োজন হয় না।

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page