সম্বনিত পদ্ধতিতে ছাগল পালন ও মাছ চাষ | Integrated Goat and Fish Farming

৮০ দশকে আমাদের দেশে ‘বাংলাদেশ মিশন’ নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান একত্রে ছাগল পালন ও মাছ চাষ প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছিল। পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণ হয় যে সম্বনিত পদ্ধতিতে ছাগল পালন ও মাছ চাষ (Integrated Goat and Fish Farming) এ ভালই ফল পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি ছাগল ও ভেড়া রয়েছে, সুতরাং এদের বিষ্ঠা ও চনা পুকুরে মাছ চাষের সার হিসাবে কাজে লাগালে অবশ্যই লাভবান হওয়া যাবে।

তবে প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে ছাগলের বিষ্ঠার একটি সমস্যা রয়েছে। বড়ির মত হওয়ার ফলে, ছাগলের বিষ্ঠা পানিতে না মিশে সরাসরি পুকুরে তলদেশে চলে যায়। যা কিনা গোবরের ক্ষেত্রে ঘটেনা।

ছাগলের বিষ্ঠা পুকুরের তলায় আস্তে আস্তে পচে অবাঞ্জিত গ্যাস, যেমন, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন, কার্বণ ডাই-অক্সাইড ও এমোনিয়া উৎপাদন করে। এর ফলে পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়।

আবার মুরগিও হাঁসের বিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, এতে ছাগলের বিষ্ঠার চেয়ে অনেক বেশি নাইট্রোজেন এবং শক্তি রয়েছে যার জন্য মুরগিও হাঁসের বিষ্ঠা ব্যবহৃত পুকুরে মাছের উৎপাদন ছাগলের চেয়ে অনেকটা বেশি।ৎ

এ সত্বেও একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, অব্যবহৃত অবস্থায় যত্রতত্র পড়ে থাকার চেয়ে ছাগলের চনা ও বিষ্ঠা মাছ চাষের পুকুরে সার হিসাবে ব্যবহার করা অনেক বেশি কাম্য।

তাছাড়া যেখানে মাছ চাষের সঙ্গে ছাগল পালন সমন্বয় করার প্রাকৃতিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে, সেখানে এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করাই বাঞ্চনীয়। যার গাভী কেনার সামর্থ নেই তিনি অল্প পুঁজিতে ছাগল পালন করে লাভবান হতে পারেন।

তাই বলা হয় ছাগলই হলো গরিবের গাভী। সর্বোপরি যেসব অসুবিধার কথা বলা হয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় তার বেশ কিছুটা অবশ্যই সুরাহা করা সম্ভব।

ছাগল পালন ও মাছ চাষের কয়েকটি প্রয়োজনীয় দিক-

-২০ টি দেশি কালো ছাগল পুকুরের কাছে তৈরি ২৮ বর্গ মিটারের একটি এজমালি ঘরে এবং সংলগ্ন একটি খোঁয়াড়ে পালন করা হবে।

পুকুরের আয়নত হবে আধা বিঘা এবং গভীরতা হবে তিন ফুট।

-পুকুরের ১০০০টি মাছের পোনা ছাড়া হবে। এর মধ্যে ৪৫০ টি হবে বিগহেড কার্প, ৪৫০ টি গ্রাসকার্প এবং ১০০ টি তেলাপিয়া। আট-ন’মাস পরে মাছ ধরা হবে।

মাছের জন্য আলাদা খাদ্য খুব একটা সরবরাহ করা হবে না। ছাগলের জন্য সরবরাহকৃত খাবারের অব্যবহৃত অংশ মাছ খাবে।

তাছাড়া ছাগলের বিষ্ঠা ও চনা নালা দিয়ে পানিতে সরাসরি চলে আসবে এবং পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য সার হিসাবে কাজ করবে।

বিষ্ঠা ও চনা ভালো করে পিষে নালায় ছাড়লে তা সহজেই পানির সঙ্গে মিশে যাবে সুতরাং পুকরের তলায় জমা হয়ে অবাঞ্জিত গ্যাস উৎপাদন করতে পারবে না।

সম্বনিত পদ্ধতিতে ছাগল পালন ও মাছ চাষ | Integrated Goat and Fish Farming

যে পদ্ধতি এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে এতে শুধু রাত্রের জন্য ছাগল ঘরে রাখা হয়। দিনের বেলায় পুকুর সংলগ্ন খোঁয়াড়ে রাখা হয়। দানাদার খাদ্য দেয়ার সময় খোয়াড়ের মধ্যে প্রত্যেকের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে এবং পরস্পরের খাদ্য খেতে পারে না।

দানাদার খাদ্য শেষ হলে যৌথভাবে ছোবড়া ও আঁশ জাতীয় খাদ্য দেওয়া হয়। ছাগল টেনে ছিঁড়ে খেতে পছন্দ করে বলে অনেক সময় খোঁয়াড়ের সাথে বিশেষ ধরনের ঝুড়িতে এ সমস্ত ছোবড়া ও আঁশ জাতীয় খাবার রাখা হয় যাতে মুখ ঢুকিয়ে টেনে ছিঁড়ে খেতে সুবিধা হয়।

এই প্রথার সুবিধাগুলো হলো তুলনামূলকভাবে খরচ কম পড়ে, শরীর চর্চার পর্যাপ্ত জায়গা থাকে, খাদ্য পরিবেশন অনেক সহজ, কোনো ছাগী গরম হলে বুঝতে পারা যায় (গরমে হলে ছাগী পালের খাশি ছাগলের পিছনে লাগে ও ঘাড়ে ওঠার চেষ্টা করে এবং খাওয়া বন্ধ করে কিছুটা আলাদা থাকে) এবং পারিবারিক খামার করা সহজ।

রাত্রে থাকার জন্য এজমালি ঘরে ৪ মাস হতে তদূর্ধ্ব বয়স পর্যন্ত প্রতি ছাগলের জন্য ১০ বর্গ ফুট জায়গা প্রয়োজন।

ছাগলের ঘুমানের জন্য মেঝেতে খড়ের বিছানা করা যায়। তবে এতে প্রচুর খড়ের প্রয়োজন পড়ে। মল মৃত্রের জন্য খড় নষ্ট হয়ে যায় ফলে পরিষ্কার করতে অতিরিক্ত লোক প্রয়োজন হয়। তেমনি খড়ে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার করতে ঝামেলার সৃষ্টি হয়।

ছাগলের ঘরে ঘুমানোর জন্য মাঁচা তৈরি করা হলে এ সমস্যা আর থাকে না। তাছাড়া ছাগল স্বভাবগতভাবে উঁচু স্থানে থাকতে পছন্দ করে। এই মাঁচা কাঠের তক্তা বা বাঁশের চটা দ্বারা তৈরি করা যায়। মাঁচা থাকলে ঘর প্রত্যহ পরিষ্কার করতে অনেক সুবিধা।

মলমূত্র খড় নোংরা করতে পারে না এবং ছাগলের মেঝে হতে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা থাকে না। ঘরের মধ্যে দেয়ালের এক ফুট দূরে লম্বা মাঁচা তৈরি করে দিলে তার উপর ছাগল আরামে ঘুমাতে পারে।

এই মাঁচা মেঝে হতে কমপক্ষে ১ ফুট সর্বাধিক ২ ফুট উঁচুতে প্রতি দেশি বড় ছাগলের জন্য ২ ফুট লম্বা ও দেড় ফুট চওড়া মাঁচা দ্বিতল বিশিষ্ট তৈরি করা যায়।

ঘরের মেঝে কাঁচা পাকা উভয় প্রকারের করা যায়। তবে অল্প খরচে ইট বিছিয়ে সোলিং করে মেঝে করা যায়। ইটের মাঝে বালু সিমেন্ট দ্বারা ফাঁক বন্ধ করে দেওয়া যায়।

ইটের মেঝেতে ছাগলের পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা কারণ মেঝেতে মলমূত্রে পিচ্ছিল হয়ে যায়। মেঝে ড্রেনের দিকে ঢালু করলে পরিষ্কার করতে সুবিধা।

অল্প খরচে মুলিবাঁশের বেড়া তৈরি করা যায়। তবে বেড়ার নিচে অন্তত একফুট পরিমাণ ইট দ্বারা পাকা করলে ছাগলের মলমূত্র এবং ঘর ধোয়ার পানি লেগে বেড়া নষ্ট হতে পারে না। গ্রামে মাটির দেয়াল তৈরি করারও রেওয়াজ আছে।

বেড়া বা দেওয়ালে মেঝে হাত ৪ ফুট পরিমাণ ভারাট হতে হবে এবং উপরের অংশ তারের বা চটার জালি অথবা ফাঁকা ফাঁকা করে ইটের গাঁথনি করা যায়। ঘরের উচ্চতা ৭ ফুট হতে ১০ ফুট হলেই যথেষ্ট।

ঘরের চালা গোলপাতা, খড়, মাটির টালি, এসবেস্টস অথবা টিন দ্বারা দোচালা ঘর করা যায়। টিনের চালা হলে চালার নিচে চাটাই দ্বারা সিলিং দিলে গরম কম লাগবে। ঘর জায়গায় অবস্থিত হওয়া উচিত যেখানে পর্যাপ্ত রোদ পাওয়া যাবে।

রোদ ছাগলের শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। তাই ছাগলের ঘর দক্ষিল অথবা পুর্বমুখী হওয়া উচিত।

দিনের বেলা ছাগল রাখার জন্য ঘরের সম্মুখে খোঁয়াড় তৈরি করতে হয়। খোয়াড় এমন জায়গায় তৈরি করতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ পড়ে কিন্তু দুপুরে ছায়া পড়ে। ঘরের প্রস্থ অনুপাত দ্বিগুন চওড়া এবং ঘরের দৈঘ্যের সমান লম্বা খোয়াড় তৈরি করতে হবে।

খোয়াড়ের বেড়ার উচ্চতা ৪ ফুট হলেই চলবে। খোঁয়াড়ের খুটি কাঠ অথবা বাঁশের তৈরি করা হয়। খোয়াড়ের ভিতর অথবা সীমানায় বড় গাছ থাকলে ছায়া হয়। ফলে ছাগল কড়া রোদে কষ্ট পায় না। গাছের ঝরা পাতা ছাগলে খায়।

গাছপালা না থাকলে খড়ের উপর নারিকেল, খেজুর অথবা গোলপাতা দ্বারা ছায়া তৈরি করে দিতে হয়।

খোঁয়াড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে কয়েকটা বালতি করে ছাগলের পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হয়। দানাদার খাদ্য দেওয়ার জন্য খোঁয়াড়ের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন একে অন্যের খাদ্য খেতে না পারে।

ঝুড়িতে ভরে রুটিন মত ছোঁবড়া ঘাস ও আঁশযুক্ত খাদ্য ও পাতা সমেত গাছের ডাল মাঝে মাঝে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়। যাতে ছাগল তার উপরের সচল ঠোঁট ও পরিগ্রাহী জিবের সাহায্যে খাদ্য ছিঁড়ে খেতে পারে।

তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ডালের পাতা মাটিতে পড়ে নোংরা না হয়। ছাগল তার নিজের দ্বারা হোক বা অপরের দ্বারা পায়ে মোড়ানো নোংরা খাবার খায় না। ছাগল খোঁয়াড়ের বেড়ায় পা দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পাতা ছিড়ে খায়।

খোয়াড় থেকে নিয়মিত ছাগলের মলমূত্র পরিষ্কার করে ড্রেনে ফেলতে হবে। এই ড্রেন ‘সার পিটের’ সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে যাতে মলমূত্র পিটে জমা হতে পারে। পিটের উপর সূর্যকিরণ ও বৃষ্টি হতে রক্ষার জন্য একটি চালা থাকে।

ছাগলের বিষ্ঠা ভালভাবে পিসে পুকুরে করা প্রয়োগ উচিত।

খুব সকালে ছাগল ঘর হতে বের করে খোঁয়াড়ে ঢুকাতে হয়। এই সময়ের মধ্যে ঘর পরিষ্কার করে ফেলতে হয়। খোঁয়াড়ের মধ্যে তারা শরীর চর্চার পর্যাপ্ত স্থান এবং সকালের সূর্যকিরণ পায়। ঘর পরিষ্কার করার পর খাবার পাত্র এবং পানির পাত্র পূর্ণ করে দিতে হবে।

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page