গলদা চিংড়ি (Golda Chingri): পরিচিতি, চাষ পদ্ধতি ও রোগ ব্যবস্থাপনা

গলদা চিংড়ি (Golda Chingri, Macrobrachium rosenbergii) বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থনৈতিক সম্পদ। এরা বিশ্বব্যাপী উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।

  • সাধারণ নাম (Local Name): গলদা চিংড়ি (Golda Chingri)
  • গলদা চিংড়ির বৈজ্ঞানিক নাম কি? (Scientific name of Golda Chingri): ম্যাক্রোব্রাচিয়াম রোসেনবারগি (Macrobrachium rosenbergii)
  • গলদা চিংড়ি ইংরেজি কি? Giant River Prawn or giant freshwater prawn

গলদা চিংড়ির শ্রেণীবিন্যাস (Taxonomy of Golda Chingri)

  • Kingdom: Animalia
  • Phylum: Arthropoda
  • Subphylum: Crustacea
  • Class: Malacostraca
  • Order: Decapoda
  • Family: Palaemonidae
  • Genus: Macrobrachium
  • Species: M. rosenbergii

গলদা চিংড়ির বৈশিষ্ট্য (শারীরিক, দৈহিক গঠন) (Body Features & Characteristics of Golda chingri)

গলদা চিংড়ি খোলসবিশিষ্ট অমেরুদন্ডী প্রাণী। গলদা চিংড়ি দেখতে গাঢ় সবুজ থেকে বাদামি বা কালচে রঙের হয়।

পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়ি থেকে আকারে বড় হয় এবং পুরুষ চিংড়ির দ্বিতীয় পা অপেক্ষাকৃত বড়, কালো এবং চিমটাযুক্ত।

গলদা চিংড়ির মাথা শরীর থেকে অনেক মোটা মাথায় পাঁচ জোড়া ও বুকে আট জোড়া উপাঙ্গ আছে।

প্রথম দুই জোড়া হাঁটার পায়ে চেলি (চলন্ত নখ) এবং তৃতীয় থোরাসিক সেগমেন্টটি দ্বিতীয়টি ওভারল্যাপ করে।

Macrobrachium গণের চিংড়ি (যার অর্থ ‘বড় বাহু’) হাঁটার পাগুলির দ্বিতীয় জোড়াটি ব্যাপকভাবে দীর্ঘায়িত হয়, প্রায়শই শরীরের দৈর্ঘ্যের সমান বা অতিক্রম করে।

দ্বিতীয় হাঁটা পা আকারে সমান এবং অনেক ছোট মেরুদন্ড বহন করে। নখের নড়াচড়ার আঙ্গুলের খুব ছোট, সূক্ষ্ম, নীচু স্পিনুল রয়েছে।

রোস্ট্রাম তরুণ পুরুষদের (১.২-১.৪ এক্স ক্যারাপেস দৈর্ঘ্য) মধ্যে দীর্ঘ, কিন্তু পুরানো নমুনা (০.৮-১.০) এক্স ক্যারাপেস দৈর্ঘ্য) মধ্যে আনুপাতিকভাবে ছোট। এটি কিছুটা উপরের দিকে বাঁকানো হয়, যা ১১-১৪ টি ডরসাল দাঁত এবং ৮-১০ টি ভেন্ট্রাল দাঁত বহন করে।

পুরুষরা ৩২০ মিমি পৌঁছাতে পারে, এবং মহিলারা ২৫০ মিমি পৌঁছাতে পারে

গলদা চিংড়ি প্রাপ্তিস্থান (Geographic Distribution of Golda Chingri)

দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র এই মাছ পাওয়া যায়।

গলদা চিংড়ি আবাসস্থল বা বাসস্থান (Habitat of Golda Chingri)

গলদা চিংড়ি পুকুর, নদী, খাল, বিল প্রভৃতি জায়গায় পাওয়া যায় । catadromous

গলদা চিংড়ি স্বাদ ও পুষ্টিমান (Taste & Nutrition of Golda Chingri)

প্রতি ১০০ গ্রামে প্রোটিন ২১.০, ফ্যাট ০.৮, লোহা ০.৮ গ্রাম ক্যালসিয়াম ৩০৪ মি.গ্রা. এবং ফসফরাস ৪১৮ মি.গ্রা. থাকে ।

গলদা চিংড়ি খাদ্যাভ্যাস (Feeding Habit of Golda Chingri) | গলদা চিংড়ির কি খায়, খাদ্য তালিকা

চিংড়ি মাছ প্রায় সর্বভুক। চিংড়ি সাধারণত জলাশয়ের নিচে চলাফেরা করে এবং সেখান থেকেই সব ধরনের খাদ্য সংগ্রহ করে।

এ ছাড়া সম্পূরক খাদ্য হিসেবে কুঁড়া, ভুষি, থৈল ফিশমিল দেয়া যেতে পারে।

গলদা চিংড়ির প্রজনন (Reproduction of Golda Chingri)

গলদা চিংড়ি মিঠা পানির মাছ হলেও নদীর মোহনায় নোনা পানি ছাড়া ডিম পাড়ে
না। এ মাছ ছয় মাস বয়সেই প্রজননক্ষম হয়। দৈর্ঘ্যে তখন ১৩-১৪ সে.মি. হয়।

গলদা চিংড়ির চাষের সুবিধা অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Benefits & Economic Importance of Golda Chingri)

গলদা চিংড়ি অত্যন্ত মূল্যবান মৎস্য সম্পদ। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববাজারে গলদা চিংড়ির ব্যাপক চাহিদার ফলে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

এ চিংড়ি পুকুরে রুই, কাতলা, সিলভার কার্প মাছের সাথে মিশ্র এবং একক পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।

অন্যান্য সুবিধাগুলো হচ্ছে:

-গলদা চিংড়ি কাঁটাবিহীন, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর।

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে গলদা চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিদেশে এ চিংড়ি রফতানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করে।

পুকুরে পরিবেশগত অবস্থা ঠিক থাকলে গলদা চিংড়ি ৬-৮ মাস বয়সেই বাজারজাত করা যায়। এ বয়সের ১৫-২০ টি গলদা চিংড়ি ১ কেজি হয়ে থাকে।

-রুই, কাতলার সাথে মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।

-গলদা চিংড়ি পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার তারতম্য সহ্য করতে পারে। মিঠা ও আধা লবণাক্ত নিচু বিল এলাকায় চাষ করা যায়।

-ধান ক্ষেতেও সহজে চাষ করা যায়।

-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হ্যাচারি থেকে অধিকাংশ সময়ই পোনা পাওয়া যায়।

-সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা, নদীর মোহন সাথে সংযুক্ত নিচু খালি এলাকা। যেখানে জোয়ার ভাটার প্রভাব থাকে সেখানে এপ্রিল হতে আগষ্ট মাস পর্যন্ত গলদা চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়।

-তা ছাড়া কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কৃত্রিম উপায়ে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের জন্য বেশ কিছু হ্যাচারি স্থাপিত হয়েছে। সেখানর থেকে মার্চ হতে আগষ্ট পর্যন্ত পোনা সংগ্রহ করা যায়।

গলদা চিংড়ির ছবি (Picture of Golda Chingri)

গলদা চিংড়ির চাষ পদ্ধতি (Culture System of Golda Chingri)

স্থান নির্বাচন

যেখানে খাল-বিল, নদী-নালা, গভীর-অগভীর নলক‚প, হস্তাচালিত নলক‚পের সাহায্যে পরিমিত পানি সরবরাহ করা যায় সেসব স্থানে গলদা চিংড়ির চাষের পুকুর নির্মাণ করা যেতে পারে।

খামারের উপরিভাগের জমি প্রায় সমতল বা একদিকে সামান্য ঢালু হলে ভাল হয়।

পুকুর প্রস্তুতি

চাষের গুরুতেই পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। পুকুর তৈরি করতে হলে প্রথমেই পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে। পুকুর শুকালে তলায় জমে থাকা ক্ষতিকর বিষাক্ত গ্যাস বের হয়ে আসবে।

পুকুরের তলা লাঙল বা ট্রাক্টর দিয়ে ভালভাবে চাষ করে ৮-১০দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুর শুকানো না গেলে প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে রোটেনন পাউডার পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।

রোটেনন ব্যবহারের আগে পানি কমিয়ে নিলে রোটেননের পরিমাণও আনুপাতিক হার কম লাগবে। মাটির প্রকারভেদে চুন প্রয়োগের মাত্রা কমবেশি হয়। নতুন পুকুর বা লাল মাটির পুকুরে চুনের মাত্রা বেশি প্রয়োজন হয়।

প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন পানিতে গুলে ছিটিয়ে দিতে হয়। পুুকুরে চুন দেয়ার ৭-৮ দিন পর শতাংশ প্রতি ৬-৭ কেজি গো-মহিষের গোবর, ৩-৪ কেজি মুরগির বিষ্ঠা, ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি, ২০ গ্রাম এমপি ও ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।

পুকুরে সার দেয়ার পর অল্প পরিমাণ পানি সরবরাহ করলে সার পচে ক্ষতিকর গ্যাসও বের হয়ে যায় এবং মাছের খাদ্য তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান পানিতে বের হয়ে আসবে। পুকুরে সার দেয়ার ৭-৮ দিন পর চিংড়ির পোনা মজুদ করতে হবে।

পুকুরে মাটি উর্বরতা, পানির গুণাগুণ, সম্পূরক খাদ্য ও পুকুর ব্যবস্থাপনার সুবিধার উপর পোনা মজুদের হার নির্ভর করে। পুকুরে এককভাবে গলদা চিংড়ি চাষ করলে একরে সাধারণত ৭,০০০-১০,০০০ পোনা ছাড়া যাবে। উন্নত খাবার সররবাহ করা গেলে এ হারে আরো বাড়ানে যাবে।

চিংড়ির খাবার

গলদা চিংড়ি পানিতে ভাসমান ছোট উদ্ভিদ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, মাছ, মরা, প্রাণীর পচা অংশ, কেঁচো ইত্যাদি খেয়ে থাকে।

খাবারের অভাব হলে দূর্বল ছোট চিংড়িকে খেয়ে ফেলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের পরিমাণও বেড়ে যায়।

তখন সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী মিশিয়ে চিংড়ির খাবার তৈরি করা যায়। চালের কুঁড়া, গমের ভূষি, মাছে, মাছের গুঁড়ো একত্রে মিশিয়ে মোয়া বানিয়ে সরবরাহ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

তবে প্রক্রিয়াজাত করে সেমাই বা বড়ি তৈরি করে খাবার প্রয়োগ করাই ভালো। এতে খাবারের অফচয় কম হয়। বিভিন্ন সামগ্রী মিশিয়ে মেশিনের সাহায্যে সেমাই/বড়ি তৈরির করা যায়।

সেমাই/বড়ি তৈরির কয়েকটি উপাদানের মিশ্রণ নিচে দেয়া হলো-

-চালের মিহি কুঁড়া শতকরা ৩০ ভাগ, মাছের গুঁড়ো ৩৫ ভাগ, আটা ২০ ভাগ ও গমের ভুষি ১৫ ভাগ।

-চালের মিহি কুঁড়া শতকরা ৩০ ভাগ, সরিষার খৈল ২০ ভাগ, মাছের গুঁড়ো ৩০ ভাগ ও গমের ভুষি ২০ ভাগ।

-চালের মিহি কুঁড়া শতকরা ৪০ ভাগ, মাছের গুঁড়ো ৩৫ ভাগ, গমের ভুষি ১০ ভাগ ও আটা ১৫ ভাগ।

-চালের মিহি কুঁড়া ২০ ভাগ, মাছের গুঁড়ো ৪০ ভাগ, সয়াবিন তেল ৫ ভাগ, গমের ভূষি ১৫ ভাগ ও আটা ২০ ভাগ।খাবার তৈরির পর ভালভাবে রোদে শুকিয়ে পরিস্কার জায়গায় রাখতে হবে।

খাদ্য সরবরাহের আনুপাতিক হার

ভৈজা মোয়া জাতীয় খাবার = মোট চিংড়ির ওজনের শতকরা ১০-১৫ ভাগ।

মেশিনে তৈরি সেমাই/বড়ি = মোট চিংড়ির ওজনের শতকরা ৬-১০ ভাগ।
(৩-৪ মাস বয়স পযর্ন্ত) মোট চিংড়ির ওজনের শতকরা ৩-৫ ভাগ।

পরিমিত ও সুষম খাবার চিংড়ির দেহ দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। নিয়মিত ৪ কেজি সুষম খাদ্য প্রয়োগ করা হলে অতিরিক্ত ১ কেজি চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

চিংড়ি খোলস পাল্টানোর সময় অন্য কোনো প্রাণী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এ জন্য পুকুরে কিছু পাতাবিহীন ডালপালা এবং বাঁশ পুঁতে দেয়া প্রয়োজন। এত চিংড়ি আশ্রয় নিতে পারে।

চিংড়ি আহরণ

পুকুরের পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকলে গলদা চিংড়ি ৬-৭ মাসের মধ্যে বাজারজাত করা যায়।

এ সময়ে ১০-১৫ টি চিংড়িতে ১ কেজি হলে তা ধরে বাজারজাত করতে ফাঁস জাল ব্যবহার করে শুধুমাত্র বড় চিংড়িগুলো ধরলে ছোট চিংড়িগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পাবে।

অমাবস্যা বা পূর্ণিমার সময় চিংড়ি ধরা উত্তম। এ সময় চিংড়ির খোলস শক্ত থাকে।

আহরণোত্তর পরিচর্যা

চিংড়ির ধরার পর পরই পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে বরফ মিশ্রিত পানিতে রাখতে হবে। তারপর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে পানিতে ধুয়ে পরিমিত গুঁড়ো বরফে ভরে দ্রুত প্রক্রিয়াজাত কারখানায় নিতে হবে।

চিংড়ি ধরে ফেলে রাখলে পচন ধরে এবং নরম হয়ে যায়। আর নরম ও পচা চিংড়ি বিক্রয়ের অযোগ্য বা দাম কত হয়।

গলদা চিংড়ির রোগবালাই (Disease and Treatment of of Golda Chingri)

চিংড়ির স্বাস্থ্য ও রোগবালাই পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিত চিংড়ির নমুনা পরীক্ষা
করতে হয়।

রোগবালাই সাধারণত কম হয় তবে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ছত্রাক ও পরজীবীর আক্রমণ হতে পারে।

যার ফলে চিংড়ির ফুলকায় কাল নাগ, দেহে ক্ষতরোগ, শ্বেত রোগ, ঘোলস না বদলানো রোগ হতে পারে।

গলদা চিংড়ি চাষে যে বিষয়গুলো জেনে রাখা জরুরী

প্রায়শই জিজ্ঞাস্য (FAQs)

গলদা চিংড়ির দাম (Price of Golda chingri)

বড় ফাঁসের বেড়জাল ব্যবহার করে বড় মাপের চিংড়ি ধরতে হয় বর্তমানে প্রতি
কেজি গলদা চিংড়ির দাম ৭০০ থেকে ২০০০ টাকা ।

একটি গলদা চিংড়ি কতদিন বাঁচে? (Lifespan of Golda chingri)
গলদা চিংড়ির কি বিপজ্জনক? (Arenthey dangerous)
গলদা চিংড়ির র্কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ? (Is Golda chingri good for health)

গলদা চিংড়ি আকৃতি, আকার এবং রঙ,মাছ দেখতে কেমন?

গলদা চিংড়ির কত বড়?

বাগদা ও গলদা চিংড়ির পার্থক্য

References

  • Barki, A; Karplus, I.; Goren, M. (1991) Morphotype related dominance hierarchies in males of Macrobrachium rosenbergii (Crustacea, Palaemonidae), Behaviour 117(3/4): 145-160
  • Barnes, Robert D. (1983) Invertebrate Zoology, Saunders, Philadelphia. Pp. 883

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page