প্লাবনভূমিতে মাছ চাষ: সম্ভাবনা ও সংশয়

নদীমাতৃক বাংলাদেশ আবহমান কাল থেকেই মৎস্যসম্পদ ভরপুর। এর মোট আয়তন প্রায় ৪০.৪৭ লক্ষ হেক্টর যার মধ্যে প্লাবনভূমি ও বিলের আয়তন যথাক্রমে ২৮.৩৩ লক্ষ ও ১.১৪ লক্ষ হেক্টর।

এক সময়ে দেশের প্লাবনভূমি থেকে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। দেশের মৎস্যজীবীদের দেশির ভাগই প্লাবনভূমি থেকে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

কিন্তু সাম্প্রতিক কালে প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে প্লাবন ভূমি থেকে মাছের উৎপাদন আশংকাজনকভাবে কমে গেছে।

এমতাবস্থায়, প্লাবনভূমির মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের জন্য রুই জাতীয় মাছের পোন মজুদ ও সুষ্টু সংরক্ষণের মাধ্যমে প্লাবনভূমির বাস্তাবসম্মত টেকসই ব্যবস্থাপনা পড়ে তোলা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

প্লাবভূমি কি?

দেশের যে নিম্নাঞ্চল সাধারণত বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যায় এবং ৪-৫ মাস পানিতে নিয়জ্জিত থাকে থাকেই প্লাবভূমি বলে বাংলাদেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিম্নাঞ্চল প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়।

এই অঞ্চলগুলির পরিবারের একটি বড় অংশ আয় বা খাবারের জন্য মাছ ধরার উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের প্লাবনভূমিতে ৩০০ টিরও বেশি মাছ এবং চিংড়ি প্রজাতির বৈচিত্র্যময় মৎস্য রয়েছে, যা এটিকে বিশ্বের অন্যতম ধনী মিঠা পানির মৎস্য হিসাবে গড়ে তুলেছে।

প্লাবনভূমির বৈশিষ্ট্য

কৃষি ফসলেল জন্য সার ব্যবহার করায় এবং প্রচুর পলি জমা হওয়ায় প্লাবনভূমির মাটি ও পানির উর্বরতা শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। এ কারণে প্লাবনভূমি মিঠা পানির অধিকাংশ মাছের প্রজনন, চারণ ও আবাস্থাল। প্লাবিতভূমি বর্ষা মৌসুমে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং বড় অংশ বিভিন্ন ধরণের আগাছ কচুরিপানা, ধানক্ষেত ইত্যাদিতে ভরে যায়।

প্লাবনভূমির বতর্মান অবস্থা

প্রতি বছর পলি জমে জমে প্লাবনভূমি অগভীর হয়ে যাচ্ছে । নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদী থেকে প্লাবনভূমিতে পযাপ্ত পানি প্রবেশ করছে না , ফলে প্লাবনভূমির আয়তন কমে যাচ্ছে।

পোনার চলন ক্ষেত্রে হিসেবে প্লাবনভূমির আগাছা, উদ্ভিজ্জ কনা, প্রাণিজ কনা, ধান ইত্যাদি এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করে। বর্তমানে প্লাবনভূমি ও নদীর মধ্যে মাছের চলার পথ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ, সুইস গেট, সেচ বাধা, রাস্তা ইত্যাদি দ্বারা বন্ধ হয়ে যাওয়া মাছের বৈচিত্র অনেক কমে গেছে।

বাংলাদেশী খাদ্যের জন্য প্রোটিন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, দরিদ্র সম্প্রদায়গুলি এখনও প্লাবনভূমির মৎস্য চাষ থেকে উপকৃত হয়। প্লাবনভূমিগুলি তরুণ মাছের প্রজাতির জন্য নার্সারি হিসাবে কাজ করে এবং মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে সময়ের সাথে সাথে তাদের এলাকা হ্রাস পেয়েছে।

অতিরিক্ত মাছ ধরার পাশাপাশি এই হ্রাসের ফলে প্লাবনভূমির মৎস্যচাষ হ্রাস পেয়েছে। প্লাবনভূমির মাছের বৃদ্ধি বন্যার মরসুমের উপর নির্ভর করে এবং বন্যার তীব্রতা এবং সময়কালের বিভিন্নতা তাদের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে।

বাংলাদেশের প্লাবনভূমির অবস্থা ও জীববৈচিত্র্য মূল্যায়ন এবং বিভিন্ন বছর, বিভাগ ও জেলায় মৎস্য উৎপাদনের বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করাই দরকার।

বিলে মাছের মধ্যে মূলত ক্ষতরোগ বেশি দেখা এবং সাধারণত এ রোগ ডিসেম্বরে শুরু হয়ে মার্চ পর্যন্ত থাকে, তবে জানুয়ারিতে এ রোগের সর্বোচ্চ প্রকোপ দেখা যায়। ক্ষতরোগে মজুদকৃত মাছের মধ্যে মৃগোল ও রাজপুুটি সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এবং অন্যান্য মাছের মধ্যে শোল, গাজার টাকি রাইম পুটি সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ প্রজাতি। পর্যবেক্ষেণে দেখা গেছে, যখন তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে।

বিলে মজুদযোগ্য পোনা মাছের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক পোনা প্রোটোজোযান পরজীবী দ্বারা আকান্ত কিছু সংখ্যক পোনা আঘাপ্রাপ্ত , আবার কিছু সংখ্যক পোনার শরীর স্লাইম (তরল পর্দার্থ) শূণ্য।

প্লাবনভূমির মৎস্যসস্পদ উন্নয়নে কার্যক্রম গ্রহন করা উচিত

প্লাবনভূমির মৎস্যসস্পদ উন্নয়নে নিম্নলিখিত গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে

১. প্লাবনভূমি/বিলেল ধরণ, পানি অবস্থানের সময়সীমা মাটি ও পানির প্রবাহ, বিলের সার্বিক পরিবেশ ইত্যাদি বিম্বয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন বিলে কত ঘনত্বে কোন কোন মাছের পোনা কত পরিমান মজুদ করা অধিকতর ফলপ্রসূ হবে তা নিরূপন করা ।

২. সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণপূর্বক পোনা মজুদ করে কোন ধরণের বিলে মৎস্য বিশ্লেষণ উৎপাদন বাড়ানো যায় যেসব বিল চিহ্নিত করা।

৩. প্লাবনভূমি/বিলে ব্যবহৃত মাছ আহরণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির শ্রেণি বিভাগ করা। মাছ ধরার কোন কো জাল/ফাদ মজুদকৃত মাছে জন্য কোন সময়ে ক্ষতিকর তা নিরুপন বিলে মজুদকৃত পোনা বিপণনযোগ্য আকার উপনীত হবার আগে তা না ধরও অন্যান্য প্রজাতির মাছ ডশ উপায়ে আহরণ করা যায় তা নিরূপন করা।

৪. বিলে মাজুদের লক্ষ্যে সুস্থ সবল পোনা উৎপাদন পরিবহণের বিভিন্ন পর্যায়ে সমস্যবলী চিহ্নিত করে পরিবনের বিভিন্ন উন্নত কৌশল নির্ধারণ, মজুদ কালে কোনা রোগবালাই হবন করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা।

৫. বিলের মাছে কোন প্রকার রোগ দেখা দিলেরোগ সনাক্তকরণ ও রোগের কারণ নিরূপন। বিশেষ করে বিলে, ক্ষতরোগের প্রকোপ, ব্যাপকতা, ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাতি ক্ষতরোগ মাছ আক্রান্ত হবার সময় ইত্যাদি বিরূপন করা।

৬. বিলের সার্বিক পরিবেশগত দিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিলে ছোট জাতের মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পন্থা উদ্ভাবন।

প্লাবনভূমিতে কমিউনিটি ভিত্তিক মৎস্য চাষের প্রভাব

বাংলাদেশে প্লাবনভূমির মৎস্য খাদ্য ও আয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তাদের কৃষি কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উপর নির্ভর করে। প্লাবনভূমিতে মাছের উৎপাদন প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়, এক গবেষণায় দেখা যায় মছের উংপাদন সর্বোচ্চ ২০০৮-০৯ সালে এবং সর্বনিম্ন ২০০১-০২ সালে।

বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে এর উৎপাদন পরিবর্তিত হয়, যার মধ্যে ময়মনসিংহে সর্বাধিক এবং ঠাকুরগাঁওয়ে সর্বনিম্ন উৎপাদন হয়। খুলনা বিভাগে সর্বাধিক প্রজাতির বৈচিত্র্য এবং সর্বাধিক মোট উৎপাদন রয়েছে, যেখানে ঢাকা বিভাগে সর্বনিম্ন।

প্লাবনভূমির আকার বৃষ্টিপাত এবং বাষ্পীভবনের উপর নির্ভর করে, ২০০৮-০৯ সাল বৃষ্টিপাত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত একটি বছর ছিল। মাছের প্রজাতির ধরন বিভিন্ন বিভাগে পরিবর্তিত হয়। জীববৈচিত্র্য পরিবর্তনের কারণ এবং উৎপাদন বৈচিত্রগুলি বোঝার মাধ্যমে, প্লাবনভূমিতে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক প্লাবনভূমি রয়েছে যা মাছ চাষের সুযোগ প্রদান করে, দরিদ্রদের উপকৃত করে। তবে অত্যধিক শোষণ এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাবনভূমিতে মাছ ধরা হ্রাস পাচ্ছে। মাছ চাষের জন্য প্লাবনভূমিসঠিকভাবে পরিচালনা করে আমরা মাছের উৎপাদন, আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারি।

কমিউনিটি-ভিত্তিক ফিশ কালচার (সিবিএফসি) একটি নতুন পদ্ধতি যেখানে বন্যার সময় সম্মিলিতভাবে মাছ চাষ করা যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে পৃথকভাবে ধান চাষ করা যায়। মাছ চাষ খাদ্য নিরাপত্তা উন্নত করতে পারে, আয় তৈরি করতে পারে এবং খাদ্য সরবরাহ এবং মাছের ব্যবহার বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মৌসুমী প্লাবনভূমিতে কমিউনিটি-ভিত্তিক মৎস্য চাষের প্রভাবগুলি দেখার জন্য ২০০৭-২০০৯ সালের তিন বছরের এক গবেষণায় দেখা যায় যে মাছের উৎপাদন ১২৪ কেজি/হেক্টর/বছর থেকে বেড়ে গড়ে ৪৬৪ কেজি/হেক্টর/বছর হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌসুমি প্লাবনভূমিতে কমিউনিটি ভিত্তিক মৎস্য চাষের প্রসার বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্লাবনভূমির উৎপাদনশীলতা ও জীবিকার উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

References

Majumdar, B. C., Shaha, D. C., Rasul, M. G., & Khan, M. (2016). Fish Production in Floodplain of Bangladesh: A Review. International Journal of Natural Sciences6(2).

Welcomme, R. (2008). World prospects for floodplain fisheries. Ecohydrology & Hydrobiology, 8(2-4), 169-182.

Haque, A. M., & Dey, M. M. (2017). Impacts of community-based fish culture in seasonal floodplains on income, food security and employment in BangladeshFood Security9, 25-38.

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page