খাঁচায় মাছ চাষ ও সম্ভাবনা

অতীতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে যে পরিমাণ মাছ আহরিত হতো, তাতেই আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যেতো। সময়ের আবর্তে দিন দিন বাড়ছে মানুষের সংখ্যা আর কমছে মাছ আহরণের পরিমাণ।

আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড জলাশয়ের পরিমাণ একদিকে যেমন কমাচ্ছে অপরদিকে তেমনি বাধা দিচ্ছে মাছের প্রজনন ও অবাধ বিচরণে।

পাশাপাশি নির্বিচারে চলছে মাছ আহরণ। এসবই মূলত এর জন্যে দায়ী। তাই আজ এসেছে মাছ চাষের কথা। ব্যাপক না হলেও বেশ সাড়া পড়েছে পুকুরে মাছ চাষের ব্যাপারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সম্ভব হয়েছে জনগোষ্ঠীর একাংশকে পুকুরে মাছ চাষের ব্যাপারে জড়িত করতে। তার কিছু কিছুসুফলও আমরা পেয়েছি ইতোমধ্যে।

আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠী বাস করছে দারিদ্র্য সীমার নিচে। অনেকেরই কোন পুকুর নেই। এই ব্যাপক জনশক্তি বঞ্চিত হয়েছে মাছ চাষের মত একটি লাভজনক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুধুমাত্র পুকুর নেই বলে।

অন্যদিকে,আমাদের রয়েছে উন্মুক্ত জলাশয় যা এখনও মাছ চাষের আওতায় আসেনি। এই জলাশয়ের আশেপাশে অসংখ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস।খাঁচায় মাছ চাষের মাধ্যমে সম্ভব হবে এই উন্মুক্ত জলাশয় ও এই মানবসম্পদকে কাজে লাগানো। বাড়বে মাছের উৎপাদন, খুলে যাবে নতুন আয়ের পথ।

শুধুমাত্র উন্মুক্ত জলাশয় নয়, কারিগরিগত, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যাগত কারণে যে সমস্ত পুকুর চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি, সেই পুকুরসমূহও খাঁচায় চাষের মাধ্যমে মাছ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। ব্যাপারটা যে কাল্পনিক কিছু নয় তার নজির এশিয়াতেই আছে।

আমাদের নিকটবর্তী দেশ যেমন ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে খাঁচায় মাছের চাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।এমনকি আমাদের দেশেও এর প্রচলন শুরু হয়েছে, যদিও খুবই ক্ষুদ্র পর্যায়ে।

খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি (Cage Fish Farming Methods)

খাঁচা স্থাপনের স্থান

নদীনালা, খালবিল, হাওরবাঁওড়, প্লাবনভূমি, সেচ প্রকল্পের খাল, লেক এবং পুকুর, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৩-৪ মাস ৪ ফুট পানি থাকে এমন জলাশয়ে খাঁচা স্থাপন করে মাছ চাষ করা যায়। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী লোনাপানি অঞ্চলেও খাঁচা স্থাপনকরে মাছ ও চিংড়ি চাষ করা সম্ভব।

খাঁচা স্থাপনের পদ্ধতি

ক) খাঁচা তৈরি

একটি মশারিকে উল্টিয়ে ঝুলিয়ে দিলে যেমনটি হবে একটি খাঁচা দেখতে ঠিক তেমনই। এর আকৃতি (Shape) সাধারণত বর্গাকার বা আয়তাকার হয়ে থাকে। খাঁচা অন্যান্য আকৃতিরও হতে পারে। তবে আকৃতি ও আকার (Size) নির্ভর করবে মূলত কোথায় আপনি খাঁচা স্থাপন করবেন তার ওপর অর্থাৎ জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য ও আপনার উৎপাদন পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার ওপর।

তবে এটুকু বলা যায় যে তিন ফুট দৈর্ঘ্য, তিন ফুট প্রস্থ ও তিন ফুট গভীরতা সংবলিত খাঁচায় ও লাভ জনকভাবে মাছ চাষ করা সম্ভব। খাঁচা সাধারণত জাল দ্বারা তৈরি করা হয়। তবে আপনি ইচ্ছে করলে তারের জাল, বাঁশের চাটাই অথবা অন্য কোন সুবিধাজনক দ্রব্য ব্যবহার করতে পারেন।

আপনাকে শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে খাঁচায় ব্যবহৃত দ্রব্যটি যাতে পানিতে সহজে পঁচে না যায়, খাঁচার ভিতর দিয়ে পানি যাতে অবাধে প্রবাহিত হতে পারে এবং খাঁচার ছিদ্র এমন হয় যাতে মজুদকৃত পোনা মাছ খাঁচার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের জাল পাওয়া যায় যেমন:সুতির, নাইলনের, টায়ারকর্ডের এবং পলিথিলিনের তৈরি।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে পলিথিলিন, টায়ারকর্ড ও নাইলনের জাল পানিতে বেশি দিন টেকে। আপনি গাব অথবা অন্য কোন ধরনের সংরক্ষক (preservative) ব্যবহার করেও জালের স্থায়িত্ব বাড়াতে পারেন। এ ধরনের জাল আপনি ঢাকার জিঞ্জিরা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও ভৈরব বাজারের জালের আড়তগুলোতে পেতে পারেন কিংবা একটু খোঁজ নিলে আপনার নিকটস্থ বাজারেও পেতে পারেন।

খাঁচা তৈরির প্রথমে আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে আপনার খাঁচার আকার ও আকৃতি, তারপর পরিমাণমত জাল কেটে চারপাশ ও তলদেশ উল্টানো মশারির মতন করে সেলাই করুন।সেলাই করার জন্য প্লাষ্টিক/নাইলনের রশি অথবা অন্য যে কোন ধরনের শক্ত রশি ব্যবহার করতে পারেন এবং এটি করতে আপনার প্রয়োজন হবে বড় ধরনের সুঁই (জাল, চটের বস্তা সেলানোর সুঁই)।

সেলাই করার সময় লক্ষ্য রাখবেন যাতে সেলাইয়ের দুটি পাশাপাশি ঘরের মধ্যে এমন ফাঁক না থাকে যার মধ্য দিয়ে মজুদকৃত পোনা মাছ বের হয়ে যেতে পারে। তারপর আপনাকে খাঁচার তলদেশে মুড়ি বেঁধে কিছু দূর পর পর ওজন (Sinker) লাগাতে হবে। কারণ জালের তৈরি খাঁচা হলে ঢেউয়ের কারণে খাঁচার তলদেশ উপরের দিকে উঠে যেতে পারে, সেজন্য ওজন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সাধারণত ঝাঁকি জালে ব্যবহৃত লোহার কাঠি ব্যবহার করা হয়।আপনি অন্য কোন কিছুও ওজন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

খ) খাঁচা পানিতে স্থাপন

খাঁচা পাানিতে স্থাপনের সময় আপনাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে খাঁচার তলদেশ যেন জলাশয়ের তলদেশের মাটি হতে কমপক্ষে ১.৫ ফুট ওপরে থাকে। খাঁচার অভ্যন্তরের পানির গভীরতা কমপক্ষে ৩ ফুট থাকতে হবে। আপনি ইচ্ছে করলে আরও বেশি রাখতে পারেন।

আপনি যদি খাঁচার উপরিভাগ পানির লেভেলে রাখতে চান তাহলে অবশ্যই খাঁচার উপরিভাগ জাল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। নাহলে মাছ খাঁচা থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাবে। আপনি যদি খাঁচার উপরিভাগ পানির লেভেলে না রাখেন তবে সে ক্ষেত্রে খাঁচাকে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে খাঁচার ওপরের অংশ পানির লেভেল থেকে কমপক্ষে ১.৫ ফুট উঁচুতে থাকে, ফলে মাছ খাঁচা থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না।

খাঁচা পানিতে রাখবেন কিভাবে?

জলাশয়ের পানির গভীরতা ও আর্থিক সামর্থ্যের দিক বিবেচনা করে খাঁচাকে দু’ভাবে পানিতে স্থাপন করা যেতে পারে। যেমন: স্থিরভাবে (fixed type) এবং ভাসমানভাবে (floating type) ।

১. স্থিরভাবে

জলাশয়ের পানির গভীরতা যদি কম হয় কিংবা আপনি যদি কম গভীরতায় খাঁচা স্থাপন করতে চান তাহলে কয়েকটি বাঁশের বা অন্যান্য ধরনের খুঁটি পানিতে পুঁতে খুঁটিগুলোর সাথে আপনার খাঁচা ঝুলিয়ে দিন।

খাঁচাটি যদি জালের তৈরি হয় তাহলে বাঁধার সুবিধার্থে খাঁচার উপরিভাগে নাইলন/প্লাষ্টিকের রশির একটি লাইনিং দিয়ে (পায়জামার দড়ির মতন) চার কোণাতে লুপ (মশারি ঝোলানোর জন্য কোণায় যেমন রশি থাকে) আকারে বের করে লুপগুলোকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিয়ে খাঁচা ঝুলিয়ে দিন।

২. ভাসমানভাবে

জলাশয়ের পানির গভীরতা যদি বেশি হয় তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে ভেলা (float) তৈরি করতে হবে। এই ভেলা আপনার খাঁচাটিকে পানিতে ভাসিয়ে রাখবে, মোটা বাঁশ পাশাপাশি বেঁধে ভেলা তৈরি করতে পারেন। কলাগাছ, তেলের ড্রাম, প্লাষ্টিকের ড্রাম দিয়েও খাঁচা ভাসিয়ে রাখা যায়।

আপনি যদি বাঁশ বা কলা গাছ দিয়ে ভেলা বানান সেক্ষেত্রে খাঁচার আকার অনুযায়ী চারখন্ড ভেলা বানিয়ে একটির মাথা আরেকটির ওপর স্থাপন করে ভালোভাবে বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে দিন। আপনার খাঁচা যাতে স্রোতে ভেসে না যায় সে জন্য খাঁচাটিকে নোঙ্গর (anchor) করাতে হবে। নোঙ্গর কি দিয়ে বানাবেন তা নির্ভর করবে জলাশয়ের স্রোতের তীব্রতা ও পানির গভীরতার ওপর।

গ) প্রজাতি নির্বাচন ও পোনা মজুদ

পুকুরে চাষযোগ্য যে কোন প্রজাতির মাছ আপনি খাঁচায় চাষ করতে পারেন।দ্রুত বর্ধনশীল ও যে কোন সাইজে বাজারজাত করা যায় এমন প্রজাতি নির্বাচন করাই বাঞ্ছনীয়। যেহেতু খাঁচায় মাছের চাষ একটি প্রায় নিবিড় পদ্ধতি তাই বড় আকারের পোনা মজুদ করা হয় এবং সাধারণত একক চাষই (monoculture) করা হয়।

আপনি ইচ্ছে করলে মিশ্র চাষও (polyculture) করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রজাতি নির্বাচনের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পুকুরে সাধারণত যে ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয় তার চেয়ে বেশি ঘনত্বে খাঁচায় পোনা মজুদ করা হয়ে থাকে।মজুদ সংখ্যা নির্ভর করবে প্রজাতি ও সাইজের ওপর।

তাছাড়া মাছ খাঁচায় কতদিন ধরে লালন-পালন করবেন,কত বড় করে বাজারজাত করবেন, কি ধরণের খাবার দেবেন, কি পরিমাণ খাবার দিবেন, খাঁচায় পানির প্রবাহ (অক্সিজেনের পরিমাণ)কেমন এবং জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ ইত্যাদির ওপরও মজুদ সংখ্যা নির্ভরশীল।

ঘ) খাদ্য

যেহেতু আপনার মজুদকৃত মাছের পক্ষে অবাধ বিচরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবেনা তাই বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহ করা বাধ্যতামূলক। পুকুরে ও চিংড়ি মাছের ঘেরে যে ধরনের খাদ্য প্রয়োগ করা হয়ে থাকে সে ধরনের খাদ্য আপনি খাঁচার মাছকে খাওয়াতে পারেন।

যেমন-চালের কুঁড়া, গমের ভুসি,খৈল, আটা, ময়দা, কুটি পানা, ইপিল-ইপিলের পাতা, মুরগি ও মাছের নাড়িভুঁড়ি, রান্না ঘরের এঁটো, পিঁপড়ার ডিম,উইপোকার ডিম, রেশম পোকা, শামুক, ঝিনুক, শুঁটকি মাছের গুঁড়ো, ফেক্টরীতে তৈরি খাবার ইত্যাদি। খাদ্যের পরিমাণ কম/বেশি করে দিয়ে দিয়ে সঠিক পরিমাণ নির্ধারন করতে পারেন।

দিনে দু বার খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। খাবার প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি দিকে আপনাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রয়োগকৃত খাদ্যের অপচয় না হয় এবং খাবার খাঁচার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে না যায়।

সেক্ষেত্রে আপনি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন,তবে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতিটি হচ্ছে মাটির পাত্র (সাকি)ছিকা/দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে তাতে খাদ্য প্রয়োগ।

ঙ) পরিচর্যা

পুকুরে চিংড়ি ঘেরের চাষের মতই পরিচর্যা/যত্ন করতে হয়। তবে ব্যতিক্রম হলো কয়েকদিন পর পর খাঁচা পরিষ্কার করতে হবে যাতে খাঁচার ফাঁকগুলো বন্ধ হয়ে গিয়ে পানির প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে।

নরম ব্রাশ দিয়ে ঘষে অথবা অন্য কোন পদ্ধতিতে আপনি এ কাজটি করতে পারেন। আরেকটি কাজ হলো নিয়মিত খাঁচা পরীক্ষা করে দেখতে হবে খাঁচায় কোন ছিদ্র হয়েছে কিনা।কাঁকড়া কাটার কারণে বা কোন কিছুর গুতো লেগে সাধারণত খাঁচায় ছিদ্র হয়। এদিকে লক্ষ্য না রাখলে মাছ পালিয়ে যাবে এবং আপনি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

কেইজেস (কেইজ অ্যাকোয়াকালচার ফর গ্রেটার ইকোনোমিক সিকিউরিটি) কেয়ার

কেইজেস (কেইজ অ্যাকোয়াকালচার ফর গ্রেটার ইকোনোমিক সিকিউরিটি) কেয়ার বাংলাদেশের কৃষি ওপ্রাকৃতিক সম্পদ সেক্টরের একটি উন্নয়নমূলক প্রকল্প। ১৯৯৫ সনের সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল খাঁচায় মাছের চাষ প্রবর্তন করা এবং তার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিকঅবস্থার পরিবর্তন করা।

কেইজেস প্রকল্প (CAGES) মেঘনা-গোমতী নদীতে (বাউসিয়া ঘাট, গজারিয়া থানা, মুন্সীগঞ্জ জেলা) সরকারের সহযোগিতায় খাঁচায় মাছের চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবনের জন্য বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা/নিরীক্ষা পরিচালনা করেছে।

Resources

  • মাৎস্য গবেষণা ইনষ্টিট্যুট, ময়মনসিংহ।

আমি কৃষিবিদ তানজিম আহমেদ, কৃষি বিষয়ক ব্লগার।

You cannot copy content of this page